মানুষের হাতে তৈরি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় স্থাপত্য চীনের মহাপ্রাচীর । যাকে ইংরেজিতে বলা হয় The Great Wall of China । মাঞ্জুরিয়া আর মঙ্গোলিয়ার যাযাবর দস্যুদের হাত থেকে চীনের উত্তর সীমান্ত রক্ষা করার জন্য মাটি, ইঁট, পাথর, কাঠ ও অন্যান্য পদার্থ দিয়ে এ প্রাচীরটি তৈরি করা হয়ে ছিল। কয়েকধাপে, কয়েকশ বছর ধরে, কয়েক সম্রাজ্যের হাতে তৈরি এ প্রাচীর। উইকিপিডিয়ার তথ্য মতে- এই প্রাচীর ৮৮৫২ কিলোমিটার লম্বা এবং প্রায় ৫ থেকে ৮ মিটার উচু।
চীনের মহাপ্রাচীর এর জানা-অজানাঃ
- পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্যের একটি হল চীনের এই মহা প্রাচীর। ১৯৮৭ সালে ইউনেস্কো এটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে।
- চাইনিজরা কিং সাম্রাজ্যের সময় খ্রিস্টপূর্ব ২০৮ সালের দিকে প্রচীরের নির্মাণ শুরু করে । চীনের প্রথম সম্রাট কিং সি হুয়াং এটি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন এবং শত্রুর হাত থেকে নিজের সম্রাজ্যকে রক্ষার জন্য দীর্ঘ করে তৈরি করেন।
- বেশিরভাগ অংশই আঁকাবাঁকা এবং উচু-নিচু পাহাড়ের ভিতর দিয়ে গেছে। এই প্রাচীর বিভিন্ন পাহাড়কে সংযুক্তও করেছে। এই মহাপ্রাচীরে ব্যবহার করা হয়েছে বড় বড় ইট আর লম্বা লম্বা পাথর। এর গড় উচ্চতা প্রায় দশ মিটার এবং প্রস্থ ৪ থেকে ৫ মিটার।
- লক্ষ লক্ষ দাস, শ্রমিকদের কঠোর পরিশ্রম এবং সম্রাটদের অত্যাচারের নিদর্শন এ মহাপ্রাচীর। তৈরির সময় দশলক্ষেরও বেশি মানুষ মারা গিয়েছিলেন এবং এটিকে “পৃথিবীর দীর্ঘতম কবরস্থান” হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
- এই মহাপ্রাচীর চীনের ৯টি প্রদেশ, শহর, স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের মধ্যে নির্মিত হয়েছিল। প্রতিরক্ষা প্রকল্প হিসেবে এই মহাপ্রাচীর চীনের বহু পাহাড় , মরুভূমি, মালভূমি, জলাভূমি অতিক্রম করে গেছে।
- যুদ্ধের সময় খাদ্য আর অস্ত্র সরবরাহের সুবিধার জন্য প্রাচীরে উপরের অংশে সমান পথের সৃষ্টি করা হয়েছিল। এছাড়া দেওয়ালের ভিতরে উঠা নামার উপযোগী পাথরের সিড়ির পথও আছে। প্রাচীরের কিছু দূর পর পর টাওয়ার তৈরি করা হয়েছে। টাওয়ার গুলোতে অস্ত্র ও খাদ্য রাখার ব্যবস্থা ছিল।
————————————–আরও পড়ুনঃ রহস্যময়ী তাজমহলের অজানা ইতিহাস।
- শি হুয়া তিং এবং তার উত্তরাধিকারী দ্বিতীয় সম্রাট ৩,০০,০০০ লোককে এই মহাপ্রাচীর তৈরিতে নিয়োগ করেছিলেন। এই দুই সম্রাটের সময় এই প্রাচীরের ৫,০০০ কিলোমিটার নির্মিত হয়েছিল। এরপর হান রাজবংশ এই মহাপ্রাচীরকে আরও ১০ হাজার কিলোমিটার দৈর্ঘ্য বাড়িয়ে দেয়। এর পরবর্তী সম্রাটদের প্রায় সবাই এই প্রাচীর খণ্ড খণ্ড বৃদ্ধি করেছে। এইসব প্রাচীর একত্রিত করলে এর দৈর্ঘ্য দাঁড়াবে প্রায় ৫০,০০০ কিলোমিটার। অবশ্য এর অনেকাংশই ধ্বংস হয়ে গেছে।
- মহাপ্রাচীরটি একটা অবিচ্ছিন্ন লম্বা দেয়াল হলেও এই প্রাচীরটিতে রয়েছে বিভিন্ন টাওয়ার, যেখানে সেনারা পাহারায় থাকতো। ধারণা করা হয় মিং সাম্রাজ্যের সময় প্রায় ১০ লক্ষ সেনা এই মহাপ্রাচীরটির পাহারায় নিয়োজিত ছিল। এটি ছিলো তাদের সামরিক প্রতিরক্ষার দুর্গ।
- মহাপ্রাচীরের নানা অংশে পোড়া মাটি বা ইটকে থরে থরে সাজানোর জন্য আঠালো করে চালের আটা বা ময়দা ব্যবহার করা হয়েছে। আর এগুলো এত শক্ত করেই জুড়েছে, বহু বছর পরও সেখানে কোনো ঘাস জন্মাতে পারেনি।
- চীনের স্টেট ব্যুরো অব সার্ভেইং অ্যান্ড ম্যাপিং ওয়েবসাইটে উল্লেখ করা হয়েছে দুই বছর সমীক্ষা চালিয়ে পশ্চিমাঞ্চলীয় গ্যানসু প্রদেশের জিয়াওপাস থেকে উত্তরাঞ্চলীয় লিয়াওনিং প্রদেশের হু মাউন্টেম পটং ১৮০ মাইল দীর্ঘ প্রাচীরের ধ্বংসাবশেষের সন্ধান পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় এটাই প্রতীয়মান হয় যে, চীনের মহাপ্রাচীর ইতিপূর্বে করা ধারণার চেয়েও বেশি দীর্ঘ।
- মহাপ্রাচীরের এমন কিছু জায়গা আছে যেখানে মানুষের পক্ষে যাওয়া অসম্ভব। এ জায়গাগুলো বলতে গেলে মানুষের আয়ত্তের বাইরে। এ কারণে সেখানকার সর্বশেষ অবস্থা পর্যবেক্ষণ সম্ভব হয়নি এবং হয়নি কোনও সংস্কারও।
- বিশেষজ্ঞদের ধারণা, পর্বতময় অপর এলাকায় প্রাচীরের আরও প্রাচীনতম অংশের সন্ধান মিলতে পারে। সে লক্ষ্যেই সমীক্ষা কাজ অব্যাহত রয়েছে। চীনের এই প্রাচীর হাজার বছর ধরে পৃথিবীর মানুষের কাছে একটি অপার বিস্ময় হয়েই আছে।
- এই প্রাচীরটি তৈরীর নেপথ্যে ছিলো কঠোর পরিশ্রম, মেধা ও মননশীলতা। তৈরীর সময় আশেপাশে যা পাওয়া গিয়েছিলো প্রায় সব ব্যবহার করা হয়েছিলো। পাথর থেকে কাঠ বাদ যায়নি কিছুই। মিং সাম্রাজ্যের সময় যখন দেয়ালটির পুনঃনির্মাণ করা হয়েছিলো তখন পাথরের জায়গায় ইট ব্যবহার করা হয়েছিলো।
- ১৮৬০ সালে শেষ হওয়া ২য় অপিয়াম যুদ্ধের পর চায়নার বর্ডার বিদেশীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া, এর ফলে ব্যবসায়ী এবং দর্শনার্থীরা এই মহা প্রাচীর সম্বন্ধে ভালভাবে প্রথম জানতে পারে। এর আগে সারা বিশ্বে প্রাচীরের তেমন কোন পরিচিতি ছিল না।
- বেইজিং-এর দিকে থাকা প্রাচীরটি যে অংশে পর্যটকদের ভ্রমণের সু্যোগ করে দেয়া হয়েছে সেটা ছাড়া প্রাচীরের অন্যান্য অংশ ধ্বংসের আশঙ্কায় রয়েছে। বর্তমানে প্রাচীরের প্রায় ২০০০ কিলোমিটার অর্থাৎ ৩০ শতাংশ ক্ষয়ক্ষতির শিকার। এর মূল কারণ প্রাকৃতিক দুর্যোগ। যদিও প্রাচীরটি টিকিয়ে রাখার জন্য চীনের সরকার সর্বাত্মক চেষ্টা করে চলছে এবং সুরক্ষার জন্য আইনও প্রণয়ন করেছে।
- প্রতিদিন বিভিন্ন দেশ থেকে চীনের এই মহাপ্রাচীরের সৌন্দর্য উপভোগ করতে ভীড় জমায় হাজার হাজার দর্শনার্থী। সকাল থেকে শুরু হয় দর্শনার্থীদের পাহাড়ের চূড়ায় ওঠার প্রতিযোগীতা এবং চলে সূর্য ডোবার আগ পর্যন্ত। সবচেয়ে বেশি ভীড় হয় বেডেলিং-এর অংশে। এই প্রাচীর ঘুরতে আসার মৌসুমে পর্যটকের সংখ্যা দিনে ৭০ হাজারও ছাড়িয়ে যায়।
বিশেষজ্ঞদের ধারণা, পর্বতময় অপর এলাকায় প্রাচীরের আরও প্রাচীনতম অংশের সন্ধান মিলতে পারে। সে লক্ষ্যেই সমীক্ষা কাজ অব্যাহত রয়েছে। চীনের এই প্রাচীর হাজার বছর ধরে পৃথিবীর মানুষের কাছে একটি অপার বিস্ময় হয়ে থাকবে।