গরুর মাংস পরিমিত পরিমাণে সঠিকভাবে খেলে এর থেকে যে পরিমাণ পুষ্টি পাওয়া যায় তার সমপরিমাণ পুষ্টি অন্য কিছু থেকে পাওয়া কঠিন। আমরা সঠিক উপায়ে খাওয়ার কথা চিন্তা না করে খাদ্যগুণ থেকে নিজেদের বঞ্চিত করি। গরুর মাংস খাওয়ার পূর্বে এর উপকারিতা, অপকারিতা ও খাওয়ার পরিমাণ সম্পর্কে জানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। 

উপকারিতাঃ

  • আমাদের শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় ৯টি পুষ্টি উপাদান আছে গরুর মাংসে। এগুলো হল প্রোটিন, জিঙ্ক, ভিটামিন বি১২, সেলেনিয়াম, ফসফরাস, নায়াসিন, ভিটামিন বি৬, আয়রন এবং রিবোফ্লেভিন।
  • গরুর মাংস শুধু শারীরিক বর্ধন নয়, বুদ্ধি-বৃত্তিক গঠন এবং রক্ত বর্ধনেও এটি ভূমিকা রাখে। ৩ আউন্স গরুর মাংসে আছে ৯-১৩ বছর বয়সী বাচ্চার দৈনিক চাহিদার ১২৫% ভিটামিন বি১২, ৯০% প্রোটিন, ৭৪% জিঙ্ক, ৪২% সেলেনিয়াম, ৩২% ভিটামিন বি৬, ৩২% আয়রন, ২৯% নায়াসিন, ২৩% রিবোফ্লেভিন এবং ১৬% ফসফরাস।

  • গরুর মাংস খনিজ লবণের চমৎকার উৎস। এতে রয়েছে জিংক, ফসফরাস, সেলেনিয়াম এবং বিপুল পরিমাণ লৌহ। গরুর মাংস গুরুত্বপূর্ণ ভিটামিনেরও উৎস। ভিটামিন বি-৩, বি-৬, বি-১২ প্রভৃতি ভিটামিনের সরবরাহ পেতে পারেন গরুর মাংস থেকে।
  • মাংস ছাড়াও হাড়, কলিজা, মগজ ইত্যাদি থেকেও প্রোটিন চলে আসে। গরুর মাংসের প্রোটিন থেকে যে অ্যামাইনো এসিড পাওয়া যায়, তা হাড় ও মাংসপেশির কাজে অনেক সাহায্য করে থাকে। ১০০ গ্রাম গরুর মাংসে ২২.৬ গ্রাম প্রোটিন পাওয়া যায়।
  • জিংক আমাদের শরীরের কোষ রক্ষণাবেক্ষণ এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে থাকে। বলা হয় ৩ আউন্স পরিমাণ গরুর মাংস দৈনিক জিংকের ৩৯ শতাংশ পূরণ করে থাকে।

অপকারিতাঃ

  • অতিরিক্ত গরুর মাংস খেলে তা থেকে প্রাপ্ত প্রোটিন কিডনি রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। এছাড়া বেশি পরিমাণে গরুর মাংস খাওয়ার কারণে রক্তে ইউরিক এসিডের মাত্রা বেড়ে যায়।
  • সপ্তাহে যারা পাঁচ বেলা গরু, খাসি কিংবা ভেড়ার মাংস খান, তাদের কোলন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।
  • যারা নিয়মিত লাল মাংস খান তাদের মধ্যে ধূমপান, মদ্যপানসহ নানা বদভ্যাস গড়ে ওঠে। এতে বেড়ে যায় হৃদরোগ ও ক্যান্সারের ঝুঁকি।
  • গরুর মাংসের অতিরিক্ত সোডিয়াম শরীরের জন্য ক্ষতিকর। বিশেষ করে উচ্চ রক্তচাপ সৃষ্টিতে বা বাড়াতে সোডিয়াম সাহায্য করে। তাই অতিরিক্ত গরুর মাংস খেলে উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে, যা হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়।
  • যারা নিয়মিত লাল মাংস খান তাদের কোলন ক্যান্সার হওয়ার হার শতকরা ১২ ভাগ বেশি। অন্যদিকে প্রক্রিয়াজাত লাল মাংসে মৃত্যু ঝুঁকি তার চেয়েও বেশি।
  • অতিরিক্ত গরুর মাংস খেলে কোষ্ঠকাঠিন্য হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে, যা থেকে পরবর্তীকালে আরো অনেক রোগের সূত্রপাত হয়।

দৈনিক কতটুকু গরুর মাংস খাওয়া যায়ঃ

গরুর মাংসের দৈনিক নিরাপদ মাত্রা হলো, ৩ আউন্স বা ৮৫ গ্রাম।

গরুর মাংস খেয়ে বদহজম, পেটে ফাঁপা ও কোষ্ঠকাঠিন্য হলে করণীয়ঃ

  • মাংস খেয়ে বদহজম হলে, ২ কাপ পানিতে ১ টেবিল চামচ দারুচিনি গুঁড়া দিয়ে জ্বাল দিন। পানি কমে অর্ধেক হলে নামিয়ে রাখুন। এরপর এ পানিতে কিছু মধু মিশিয়ে গরম গরম দিনে দুবার পান করুন।
  • বদহজমের জন্য ১ কাপ পানিতে ১ টেবিল চামচ সাদা ভিনেগার ও ১ চা চামচ মধু মিশিয়ে পান করুন।
  • ২ কাপ পানিতে একটুকরা আদা কুচিয়ে জ্বাল দিয়ে ১ কাপ পরিমাণ করে এতে সামান্য মধু মিশিয়ে পান করুন। বদহজমের জন্য এটি ভালো কাজ করে।
  • বদহজমের জন্য কুসুম গরম পানিতে সামান্য লবণ মিশিয়ে পান করলেও উপকার পাবেন।
  • কয়েক কোয়া কাঁচা রসুন চিবিয়ে খান। পেট ফাঁপা কমে যাবে।
  • মাংস খাওয়ার পর এক টুকরা আদা মুখে নিয়ে চিবিয়ে খান। পেটে গ্যাস জমবে না।
  • পেট ফাঁপার সাথে পেটে ব্যথা হলে, কুসুম গরম পানিতে আধা কাপ লেবুর রস মিশিয়ে খান। ব্যথা কমে যাবে।
  • কোষ্ঠকাঠিন্য হলে, রাতে ঘুমানর আগে এবং সকালে ঘুম থেকে উঠার পর ১ গ্লাস পানিতে ১ টেবিল চামচ ইসবগুল মিশিয়ে সঙ্গে সঙ্গে পান করুন। কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয়ে যাবে। (বিঃ দ্রঃ- ইসবগুল পানিতে ভিজিয়ে রাখলে উপকারিতা নষ্ট হয়ে যায়। )
  • কোষ্ঠকাঠিন্যের জন্য এলভেরা পাতা থেকে জেল বের করে ১ গ্লাস পানিতে মিশিয়ে খালি পেটে পান করুন। উপকার পাবেন।

সতর্কতাঃ

  • রোগাক্রান্ত পশু জবাই করে তার মাংস খেলে মাংসে থকা জীবাণু দেহে বিষ উৎপন্ন করে। যা নানা ধরনের রোগের সৃষ্টির কারণ হতে পারে।
  • মাংস অস্বাস্থ্যকর উপায়ে রান্না করা হলে মাংস থেকে ফিতা কৃমির সৃষ্টি হয় যা থেকে পেট ব্যথা, মাথা ধরা, খিঁচুনীত, পেট খারাপ ও জ্বর হতে পারে।
  • বেশি তাপে মাংস রান্না করলে মাংসে থাকা প্রোটিন, ভিটামিন ও খনিজ লবন নষ্ট হয়ে যায়। তাই ৮০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় ধীরে ধীরে রান্না করা উচিত।
  • মাংস ভালোভাবে রান্না করা উচিত। রান্না করা মাংস বারবার জ্বাল দিয়ে বেশিদিন ধরে খাওয়া ঠিক নয়।
  • ২৫ এর বেশি বয়সী যাদের রক্তে কোলেস্টরলের মাত্রা ২০০-এর বেশি, তাদের রেড মিট বা লাল মাংস না খোয়া উত্তম।
  • যাঁদের কিডনিতে সমস্যা রয়েছে তাঁদের অবশ্যই গরুর মাংস এড়িয়ে যেতে হবে। তাছাড়া গবেষণায় দেখা গেছে যাঁরা অতিরিক্ত গরুর মাংস খান, তাঁদের ক্যানসার ঝুঁকি বেড়ে যায়।

পরামর্শঃ

  • মাংস কাটার সময় দৃশ্যমান চর্বি আলাদা করে ফেলে দিন।
  • দৈনিক ৩ আউন্স বা ৮৫ গ্রামের বেশি মাংস খাবেন না।
  • সপ্তাহে ৩০০ গ্রামের বেশি মাংস খাওয়া থেকে বিরত থাকুন।
  • রান্নায় পরিমাণে কম তেল ব্যবহার করুন।
  • ঘি বা বাটার ব্যবহার না করে সয়াবিন অথবা পাম অয়েল ব্যবহার করুন।
  • মাংসের সাথে প্রচুর শাক-সবজি ও ফলমুল খাদ্য তালিকায় রাখুন।
  • কাঁচা মাংসে দ্রুত ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ হয়, তাই যথাসময়ে মাংস সংরক্ষণ করুন।

আরও পড়ুনঃ পুষ্টিগুণে ভরা আনারসের উপকারিতা ও অপকারিতা।