Spread the love

‘ডেঙ্গু’ ভাইরাসজনিত একটি রোগ। এডিস ইজিপ্টাই মশার মাধ্যমে এ ভাইরাস ছড়ায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরের উপকুল অঞ্চলে ইউএস আর্মি কমিশনে স্যান্ডফ্লাই ফিভারের ওপর কাজ করতে গিয়ে ‘ডক্টর আলবার্ট সাবিন’ প্রথম ডেঙ্গু শনাক্ত করেন। ডেঙ্গুর সবচেয়ে মারাত্মক ধরণ হলো ডেঙ্গু হেমোর‍্যাজিক। এটি ১৯৮১ সালে কিউবায় এবং ১৯৮৯ সালে ভেনিজুয়েলায় মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৬৪ সালে বাংলাদেশে প্রথম ডেঙ্গু দেখা দেয়। তখন রোগ নির্ণয় সম্ভব হয়নি বলে এর নাম দেয়া হয় ‘ঢাকা ফিভার’। আজ আমরা ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ ও ডেঙ্গু সম্পর্কিত অজানা কিছু তথ্য সম্পর্কে জানব।

ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ

  • একজন ডেঙ্গু রোগীর ১০১-১০৪ ডিগ্রি জ্বর থাকতে পারে। জ্বর একটানা থাকতে পারে আবার জ্বর ছেড়ে যাওয়ার পরও পুনরায় আসতে পারে।
  • মাথা ব্যথা, মাথাঘোরা, বমিবমি ভাব, চোখের পেছনের অংশে ব্যথা, চামড়ায় লালচে দাগ ও র‍্যাশ হতে পারে।
  • শরীর ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে মনে হওয়া, শরীর ম্যাজম্যাজ করা ও ক্ষুধা কমে যাওয়া।
  • ডেঙ্গুর সবচেয়ে খারাপ লক্ষণ হলো- প্রচণ্ড পেটে ব্যথা, পেট ফুলে যাওয়া, রক্তবমি, শরীরের নানা স্থান থেকে রক্তক্ষরণ, রক্তচাপ হঠাৎ কমে যাওয়া, নাড়ীর স্পন্দন অত্যন্ত ক্ষীণ ও দ্রুত হওয়া, হাত পা ও শরীরের অন্যান্য অংশ ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া, প্রস্রাব কমে যাওয়া, হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে ফেলা, রোগীর অস্থিরতা বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি।
  • এই মশা কামড়ানোর ৪-১০ দিনের মধ্যে দেহে বংশবৃদ্ধি করে রোগের লক্ষণ সৃষ্টি করে।

ডেঙ্গু সম্পর্কিত জরুরি তথ্য

  • ডেঙ্গু কোনো নতুন রোগ নয়। ৯৯২ সালে চীনে ‘পানি বিষ’ নামক জ্বরের মাহামারির যে বিবরণ পাওয়া যায় তা বর্তমান ডেঙ্গু উপসর্গের সাথে মিল রয়েছে। পরবর্তীতে ১৬৩৫ সালে ফরাসি ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও ১৬৬৯ সালে পানামায় জ্বরের যে মহামারি হয় সেটিকেও ডেঙ্গু বলে ধারণা করা হয়।
  • ‘ডক্টর আলবার্ট সাবিন’ ১৯৪৪ সালে ডেঙ্গু-১ ও ডেঙ্গু-২ নামে দুটো ভাইরাসকে পৃথক করেন। ১৯৫৬ সালে হ্যামন এবং তাঁর সহকর্মীরা শনাক্ত করেন আরো দুটো নতুন ভাইরাস যার নাম দেয়া হয় ডেঙ্গু-৩ ও ডেঙ্গু-৪।
  • ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি ধরণ বা সেরোটাইপ হলো- DENV-1, DENV-2, DENV-3, DENV-4    

  • সাধারণত আমদের দেহে দেড় লক্ষ থেকে চার লক্ষের মধ্য প্লাটিলেটের পরিমাণ থকে। কিন্তু ডেঙ্গুভাইরাসের তীব্রতা বাড়ার সাথে সাথে রক্তে প্লাটিলেটের পরিমাণ কমতে থাকে।
  • চিকিৎসকদের মতে এডিস মশা শুধু দিনেই নয়, রাতের উজ্জ্বল আলোতেও সক্রিয় থাকে।
  • ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীকে স্পর্শ করলে, তার কিছু ব্যবহার করলে এবং একই বিছানায় ঘুমালে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই কারণ ডেঙ্গু কোনো  ছোঁয়াচে রোগ নয়।
  • ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত রোগীকে কামড়ানো মশা অন্য সুস্থ মানুষকে কামড়ালে তার ডেঙ্গু হতে পারে। আর ডেঙ্গু অন্যদের মাঝে এ ভাবেই ছড়ায়।
  • আগে আমরা জানতাম এডিস মশা সচ্ছ পরিষ্কার পানিতে হয়, কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে নোংরা পানিতেও এ মশা ডিম পাড়ে এবং সারাবছরই ডেঙ্গুর প্রকোপ লক্ষ্য করা যায়।

  • বিশেষজ্ঞদের মতে একজন ডেঙ্গু রোগী দৈনিক ১২ গ্লাস বা ৩ লিটার পানির প্রয়োজন হয়।
  • ডেঙ্গু জ্বরের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো ঔষধ এখনো আবিস্কৃত হয়নি। তবে ডেঙ্গু জ্বর হলে প্যারাসিটামল খাওয়া যাবে। এক্ষেত্রে স্বাভাবিক ওজনের প্রাপ্ত বয়স্ক একজন ব্যাক্তি প্রতিদিন সর্বোচ্চ চারটি প্যারাসিটামল খেতে পারবেন।
  • ডেঙ্গু রোগী যদি ডাবের পানি, খাবার স্যালাইন ও শরবত পর্যাপ্ত পরিমাণে খেতে পারেন, তাহলে শিরা পথে খুব বেশি স্যালাইন  দেওয়ার প্রয়োজন নেই। তবে চিকিৎসকদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে থাকতে হবে।
  • প্লাটিলেট দ্রুত বাড়াতে পেঁপে, ডালিম ও ব্রকলী খুবই কার্যকরী।
  • ডেঙ্গু রোগীকে কোনোভাবেই অতিরিক্ত তেল, মশলা ও ফাস্টফুড জাতীয় খাবার খাওয়ানো যাবে না।
  • একজন মানুষ তার জীবনকালে ৪ বার পর্যন্ত ডেঙ্গুজ্বর আক্রান্ত হতে পারে। যে একবার ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়েছে, পরবর্তী সময়ে তার ডেঙ্গু হলে তিনি মারাত্মক ঝুঁকিতে থাকেন।

  • ডেঙ্গু ভাইরাস কবলিত এলাকা থেকে ফিরে আসার ১৪ দিন পর জ্বর হলে নিশ্চিত হওয়া যায়, তা ডেঙ্গু জ্বর নয়।
  • ডেঙ্গু ভাইরাসজনিত রোগ হওয়ায় এতে এন্টিবায়োটিকের কোনো ভূমিকা নেই। তবে ডেঙ্গুজ্বরের সাথে ব্যাকটেরিয়াজনিত অন্য কোনো রোগ থাকলে এন্টিবায়োটিকের প্রয়োজন হতে পারে।
  • জ্বর শুরুর ৪ বা ৫ দিন পর রক্তের প্লাটিলেট কাউন্ট কমতে শুরু করে। তাই ৪ বা ৫ দিন রক্তের সিবিসি ও প্লাটিলেট পরীক্ষা করা প্রয়োজন।
  • ডেঙ্গু রোগীর রক্তের অন্য পরীক্ষা সিবিসি ও ইএসআর – ডেঙ্গু পজেটিভ আসলে এই পরীক্ষাগুলো একদিন পর পর করানো উচিত। কারণ প্লাটিলেটের ও ডব্লিউবিসি বা শ্বেত- রক্তকনিকার কম-বেশি দেখে ডেঙ্গু পরিস্থিতি অনুমান করা হয়।
  • ডেঙ্গু জ্বরের ক্ষত্রে প্লাটিলেটের হিসাব নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। প্লাটিলেট কাউন্ট ১০ হাজারের নিচে নামলে অথবা শরীরের কোনো জায়গা থেকে রক্তপাত হলে প্রয়োজনে প্লাটিলেট বা ফ্রেশ রক্ত দেওয়া যেতে পারে। তবে এ ধরণের পরিস্থিতি খুব কমই হয়।

  • ডেঙ্গু জ্বর কমার ৪৮-৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত সময় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই সময় রোগীর রক্তনালী ও রক্তের বিভিন্ন ধরণের পরিবর্তন হয়ে রোগীর নানা প্রকার সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই রোগীকে সর্বোচ্চ সতর্কতার সাথে পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং পরবর্তী জটিলতা এড়াতে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
  • বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রথমবারে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর বিশেষ কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। এটিকে বলা হয় ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু।

আরও পড়ুনঃ হামিংবার্ড – প্রকৃতির এক আশ্চর্য সৃষ্টি

  • ডেঙ্গুর কারণে মারাত্মক রক্তক্ষরণজনিত অসুস্থতা হলে তাকে  হেমোর‍্যাজিক ফিভার বা  ডেঙ্গু শক সিনড্রোম বলে। হেমোর‍্যাজিক ফিভার হলে রক্তে অণুচক্রিকার পরিমাণ কমে যায়। রোগীর রক্ত সঞ্চালন ব্যাহত হয়। ফলে নাক, ও মাঢ়ি থেকে রক্ত পড়া, রক্ত বমি হওয়া, ত্বকের নিচে রক্তক্ষরণ, পায়খানা এবং প্রস্রাবের সাথে রক্ত পড়া প্রভৃতি উপসর্গ দেখাদেয়।
  • ১৯৬০ -২০১০ সালের মধ্যে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের পরিমাণ ৩০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
  • ডেঙ্গুর চারটি সেরোটাইপের সবগুলোকেই মোকাবেলা করতে পারে এমন ডেঙ্গু ভ্যাকসিনের উপর বর্তমানে অনেকগুলো গবেষণা চলমান রয়েছে।

পরামর্শ

  • মশার কামড় এড়িয়ে চলাই হচ্ছে ডেঙ্গু প্রতিরোধের প্রধান উপায়।
  • মশার আবাসস্থল ধ্বংস কারার মাধ্যমে মশার বংশবিস্তার প্রতিরোধ করতে হবে।
  • এমন ধরণের পোশাক পড়তে হবে, যাতে শরীরের বেশির ভাগ অংশ ঢেকে থাকে।
  • বিশ্রামের সময় মশারি ব্যবহার করুন।
  • ডেঙ্গু জ্বর হলে পরিপূর্ণ বিশ্রাম ও বেশি বেশি তরল খাবার গ্রহণ করতে হবে।
  • রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ধরনের এন্টিবায়োটিক ও ননস্টেরয়েডাল প্রদাহপ্রশমী ওষুধ সেবন করা যাবে না।
  • মনে রাখবেন, অ্যাজমা ও ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য ডেঙ্গু হতে পারে বিপজ্জনক ও প্রাণঘাতী।

ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ


Spread the love