শিশুরা শারীরিক ও মানসিক বিকাশের সবচেয়ে সংবেদনশীল পর্যায়ে থাকে। বিশেষ করে ৬ মাস থেকে ৫ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের দেহ অত্যন্ত সংবেদনশীল থাকে, এবং এ সময় তাদের হজমতন্ত্র, ইমিউন সিস্টেম ও দাঁতের গঠন ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে। এই সময়ে শিশুরা যা খায়, তা সরাসরি তাদের স্বাস্থ্য, বিকাশ ও ভবিষ্যতের ওপর প্রভাব ফেলে। তাই এই বয়সের শিশুদের খাদ্য নির্বাচন করার সময় বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। আজ আমরা এমন কিছু খাবার নিয়ে আলোচনা করব, যেগুলো শিশুকে কখনোই খাওয়ানো উচিত নয়।
শিশুদের যে খাবারগুলো খাওয়াবেন না
১. মধু
যদিও মধু প্রাকৃতিক ও উপকারী খাবার হিসেবে পরিচিত, তবে নবজাতক ও ১ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য এটি মারাত্মক বিপদজনক খাদ্য। মধুর মধ্যে Clostridium botulinum নামক একটি ব্যাকটেরিয়ার স্পোর (spore) থাকে, যা শিশুদের নাড়িতে গিয়ে টক্সিন তৈরি করে, যাকে বলে বোটুলিজম। তাই ১ বছরের কম বয়সী শিশু মধু খেলে কোষ্ঠকাঠিন্য, শ্বাসকষ্ট, শারীরিক দুর্বলতা, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
২. গরুর দুধ
গরুর দুধ পুষ্টিকর হলেও, ১ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য এটি মোটেই উপযুক্ত নয়। অনেক বাবা-মা না জেনে ছোট শিশুদের গরুর দুধ খাওয়ান, যা শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে। কারণ গরুর দুধে প্রোটিন ও মিনারেলের পরিমাণ বেশি, যা ছোট শিশুদের অপরিপক্ব হজমতন্ত্র সহজে হজম করতে পারে না।
৩. আঙুর, বাদাম, পপকর্ন , ক্যান্ডি ও শক্ত খাবার
শিশুরা সাধারণত ১ থেকে ৪ বছর বয়সের মধ্যে ভালোভাবে চিবিয়ে ও গিলতে শেখে। এই সময়ে কিছু খাবার যেমন আঙুর, বাদাম, পপকর্ন, ক্যান্ডি, মার্শমেলো,গিলতে সমস্যা হয় খাদ্য ও যেকোনো ধরণের শক্ত খাবার শিশুদের জন্য শ্বাসনালীতে আটকে গিয়ে শ্বাসরোধের (Choking) বড় ঝুঁকি তৈরি করে।
৪. . ফাস্ট ফুড, হাই-সুগার বা লবণাক্ত স্ন্যাকস ও প্যাকেটজাত খাবার
এখন শিশুদের মধ্যে বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাত ফাস্ট ফুড ও প্যাকেটজাত খাবার যেমন—চিপস, মার্শমেলো, জেলি বিনস ও ইনস্ট্যান্ট নুডলস ইত্যাদি। এসব খাবার সুস্বাদু ও সহজলভ্য হলেও, স্বাস্থ্যগত দিক থেকে শিশুদের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। প্রক্রিয়াজাত খাবারে সাধারণত থাকে উচ্চমাত্রায় চিনি, লবণ, ট্রান্স ফ্যাট, কৃত্রিম রঙ, স্বাদবর্ধক এবং সংরক্ষণকারী রাসায়নিক উপাদান। এগুলো শিশুর শারীরিক বিকাশ, হজমশক্তি, মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা ও ভবিষ্যৎ স্বাস্থ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
৫. কাঁচা বা আধসিদ্ধ ডিম
ডিম পুষ্টিতে ভরপুর একটি খাদ্য, তবে শিশুদের জন্য এটি সঠিকভাবে রান্না করে দেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ কাঁচা বা আধসিদ্ধ ডিম শিশুর শরীরে গুরুতর খাদ্যবিষক্রিয়া (Food Poisoning) ঘটাতে পারে, বিশেষ করে যদি তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল থাকে।
- কাঁচা বা আধসিদ্ধ ডিমে Salmonella enteritidis নামক ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া থাকতে পারে। এটি পেটের গুরুতর ইনফেকশন সৃষ্টি করে, যা শিশুদের জন্য হতে পারে জীবনঘাতী ।
- কাঁচা ডিমের সাদা অংশে অ্যাভিডিন (Avidin) নামক প্রোটিন থাকে, যা ভিটামিন বায়োটিন (B7) শোষণে বাধা দেয়। বায়োটিনের অভাবে ত্বকের সমস্যা, চুল পড়া এবং মেটাবলিজমে ব্যাঘাত ঘটতে পারে।
৫. ক্যাফেইনযুক্ত পানীয়
ক্যাফেইন এমন একটি উত্তেজক রাসায়নিক যা প্রাকৃতিকভাবে চা, কফি, ডার্ক চকোলে এবং অনেক সফট ড্রিংকে থাকে। এটি শিশুদের দেহে গুরুতর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে।
- ক্যাফেইন শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশ ও স্নায়ুর স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত করে, ফলে চঞ্চলতা,মনোযোগের অভাব ও উদ্বেগ দেখা দেয়।
- ক্যাফেইন ঘুমের চক্র নষ্ট করে, শিশু ঘুমাতে চায় না বা বারবার জেগে যায়। এতে মানসিক ও শারীরিক বিকাশে বাঁধা পড়ে।
- অতিরিক্ত ক্যাফেইন শিশুদের হৃদস্পন্দন অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে দেয়, যা স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হতে পারে।
৬. আচার ও টকজাত খাবার
আচার ও টকজাত খাবার অনেক সময় শিশুদের খুব প্রিয় হয়ে ওঠে। বিশেষ করে বড়দের দেখাদেখি খেতে চায়। তবে এ খাবারগুলো শিশুদের শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর ও অপুষ্টিকর। শিশুর বয়স ও হজম ক্ষমতা অনুযায়ী এসব খাবার একদমই উপযুক্ত নয়। টক বা আচারে ব্যবহৃত অতিরিক্ত মসলা ও ভিনেগার শিশুর হজমে সমস্যা, গ্যাস্ট্রিক ও ডায়েরিয়া সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষ করে টক জাতীয় খাবার দাঁতের এনামেল নষ্ট করে দেয়, ফলে দাঁত ক্ষয়ে যেতে পারে।
৭. সামুদ্রিক মাছ
সামুদ্রিক সামুদ্রিক মাছ সুস্বাদু ও পুষ্টিকর হলেও, ছোট শিশুদের জন্য এগুলো হতে পারে অজানা বিপদের উৎস। বিশেষ করে ১ থেকে ৫ বছর বয়সী শিশুদের শরীর ও হজম ক্ষমতা এসব খাবার সহ্য করতে সক্ষম নয়। এছাড়া কিছু সামুদ্রিক মাছ যেমন টুনা, ম্যাকেরেল ইত্যাদিতে পারদের পরিমাণ বেশি থাকে, যা শিশুদের মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে।
৮. প্রক্রিয়াজাত মাংস
বর্তমান সময়ে বিভিন্ন রকম প্রক্রিয়াজাত মাংস যেমন– সসেজ, সালামি, হটডগ, মাংসের বল, ক্যানজাত বিফ বা চিকেন – সহজে পাওয়া যায় ও রান্নার ঝামেলাও কম। কিন্তু এই খাবারগুলো শিশুদের জন্য একেবারেই উপযুক্ত নয়, বরং নীরব বিপদের উৎস। প্রক্রিয়াজাত মাংসে সাধারণত ব্যবহার করা হয় সংরক্ষণকারী রাসায়নিক (সোডিয়াম নাইট্রেট), অতিরিক্ত লবণ, ফ্যাট, কৃত্রিম স্বাদ ও রঙ, যা শিশুর স্বাস্থ্যে নানাবিধ নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এসব উপাদান শিশুদের হজমশক্তি দুর্বল করে, কিডনি ও লিভারে চাপ সৃষ্টি করে এবং ভবিষ্যতে স্থূলতা ও হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
জেনে রাখুন
- শিশু ১ বছর পূর্ণ হওয়ার পর থেকে ধীরে ধীরে অল্প পরিমাণে মধু খাওয়ানো নিরাপদ হতে পারে।
- গরুর দুধ ভালোভাবে ফুটিয়ে ও ঠান্ডা করে শিশু ১ বছর পূর্ণ হওয়ার পর সামান্য করে দেওয়া যেতে পারে।
- আধসিদ্ধ ডিম নয়, সম্পূর্ণ সিদ্ধ ডিমই শিশুর জন্য নিরাপদ।
- বাদাম বেটে বা পেস্ট করে (যেমন পিনাট বাটার) দেওয়া যেতে পারে।
- আঙুর বা চেরির মতো গোল ফল, লম্বায করে কেটে নিন, তারপর ছোট টুকরো করে দিন।
- শিশুকে সামুদ্রিক খাবার দেওয়ার আগে পেডিয়াট্রিশিয়ানের সাথে পরামর্শ করুন, বিশেষ করে যদি পরিবারে ফুড অ্যালার্জির ইতিহাস থাকে।
- শিশুর পুষ্টি নিশ্চিত করতে প্রাকৃতিক ও ঘরোয়া পদ্ধতিতে রান্না করা তাজা মাংসই সবচেয়ে নিরাপদ ও উপকারী।