কলা খাওয়ার উপকারিতা ও পুষ্টিগুণ – জানুন কেন কলা শরীরের জন্য উপকারী

কলা একটি অতি পরিচিত ও সহজলভ্য ফল যা বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশে খাওয়া হয়। এটি শুধু স্বাদে মিষ্টি নয়, বরং পুষ্টিগুণেও ভরপুর। প্রাকৃতিকভাবে শক্তির উৎস হিসেবে পরিচিত এই ফলটি শিশু থেকে বৃদ্ধ-সব বয়সের মানুষের জন্যই উপকারী। কলায় থাকা গুরুত্বপূর্ণ ভিটামিন, খনিজ ও আঁশ আমাদের শরীরের নানা প্রয়োজন মেটাতে সাহায্য করে। তাই দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় কলা যুক্ত করা হলে তা শরীরের সামগ্রিক সুস্থতা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। আজ আমরা কলা খাওয়ার উপকারিতা ও পুষ্টিগুণ নিয়ে আলোচনা করব।

কলা খাওয়ার উপকারিতা ও পুষ্টিগুণ

১. তাৎক্ষণিক শক্তি সরবরাহ করে

  • কলা প্রাকৃতিকভাবে গ্লুকোজ, ফ্রুক্টোজ ও সুক্রোজ সমৃদ্ধ, যা দ্রুত শরীরে শক্তি যোগায়।
  • সকালের নাশতা বা ব্যায়ামের আগে কলা খেলে ক্লান্তি দূর হয়।
  • কার্বোহাইড্রেটসমৃদ্ধ হওয়ায় এটি দেহের জ্বালানি হিসেবে কাজ করে।
  • কলা ক্রীড়াবিদ ও পরিশ্রমী ব্যক্তিদের জন্য আদর্শ ফল।

২. হজম শক্তি বৃদ্ধি করে

  • কলায় থাকা ডায়েটারি ফাইবার অন্ত্রের গতিশীলতা স্বাভাবিক রাখে।
  • পেটের ভেতরে জমে থাকা বর্জ্য সহজে নির্গত হতে সাহায্য করে।
  • এতে পেক্টিন নামক উপাদান থাকে, যা অন্ত্রে প্রাকৃতিক পরিষ্কারক হিসেবে কাজ করে।
  • নিয়মিত কলা খেলে কোষ্ঠকাঠিন্য, অম্বল ও বদহজম থেকে রেহাই পাওয়া যায়।

৩. হৃদরোগ প্রতিরোধ করে

  • কলা পটাসিয়াম সমৃদ্ধ, যা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে।
  • এটি হৃদস্পন্দন স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে, ফলে হৃদরোগের ঝুঁকি কমে।
  • পটাসিয়াম শরীরের অতিরিক্ত সোডিয়ামের প্রভাব কমিয়ে দেয়, যা উচ্চ রক্তচাপের কারণ।
  • নিয়মিত কলা খাওয়ার মাধ্যমে হার্ট সুস্থ ও কার্যক্ষম থাকে।

৪. রক্তশূন্যতা রোধে সহায়ক

  • কলায় আয়রন ও ভিটামিন B6 থাকে, যা রক্তে হিমোগ্লোবিন তৈরিতে সহায়ক।
  • হিমোগ্লোবিন রক্তে অক্সিজেন পরিবহনে ভূমিকা রাখে।
  • রক্তশূন্যতা বা অ্যানিমিয়ার কারণে দুর্বলতা, ক্লান্তি ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দেয়।
  • প্রতিদিন কলা খেলে রক্তশূন্যতা কমে ও শরীর চনমনে থাকে।

৫. মন ভালো রাখে

  • কলায় ট্রিপটোফ্যান নামক অ্যামিনো অ্যাসিড থাকে, যা মস্তিষ্কে গিয়ে সেরোটোনিনে রূপ নেয়।
  • সেরোটোনিন হরমোন মস্তিষ্কে আনন্দ ও প্রশান্তি তৈরি করে।
  • এটি বিষণ্নতা, দুশ্চিন্তা ও হতাশা কমাতে কার্যকর।
  • স্নায়বিক ভারসাম্য রক্ষা করে কলা মানসিক স্বাস্থ্য উন্নত করতে সাহায্য করে।

৬. মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা উন্নত করে

  • কলায় থাকা ভিটামিন B6 নিউরোট্রান্সমিটার তৈরিতে সহায়তা করে, যা স্নায়ুতন্ত্র সচল রাখে।
  • এটি স্মৃতি শক্তি বাড়াতে ও শেখার গতি উন্নত করতে সাহায্য করে।
  • ছাত্রদের পরীক্ষার সময় মনোযোগ ও বুদ্ধি ধরে রাখতে কলা অত্যন্ত উপকারী।
  • নিয়মিত কলা খেলে মানসিক সতর্কতা ও সৃজনশীলতাও বাড়ে।

৭. ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে

  • কলা ফাইবার সমৃদ্ধ, যা দীর্ঘ সময় পেট ভরা রাখে।
  • অতিরিক্ত খাবারের প্রবণতা কমে যায় ও ওজন বাড়ে না।
  • এতে চিনি থাকলেও তা প্রাকৃতিক এবং রক্তে ধীরে ধীরে শোষিত হয়।
  • সুস্থভাবে ওজন কমাতে চাইলে কলা স্বাস্থ্যকর স্ন্যাকস হতে পারে।

৮. ত্বক ও চুলের জন্য উপকারী

  • কলায় আছে ভিটামিন A, C, এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা ত্বকের কোষ নবায়নে সহায়তা করে।
  • ত্বকে প্রাকৃতিক আর্দ্রতা ধরে রাখতে সাহায্য করে ও উজ্জ্বলতা বাড়ায়।
  • চুলে পটাসিয়াম ও জিঙ্কের প্রভাবে চুল শক্তিশালী ও চকচকে হয়।
  • ত্বকে ও চুলে কলার পেস্ট ব্যবহার করলেও উপকার পাওয়া যায়।

৯. হাড় শক্তিশালী করে

  • কলার ম্যাগনেশিয়াম ও পটাসিয়াম ক্যালসিয়ামের শোষণে সহায়তা করে।
  • এতে ভিটামিন C ও B6 থাকায় হাড়ের গঠন ও রক্ষণাবেক্ষণে ভূমিকা রাখে।
  • এটি অস্টিওপরোসিস বা হাড় ক্ষয় প্রতিরোধে সাহায্য করে।
  • বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের জন্য কলা খাওয়া জরুরি।

১০. গ্যাস্ট্রিক ও আলসার প্রতিরোধ করে

  • কলা পাকস্থলীতে একটি প্রাকৃতিক সুরক্ষা স্তর তৈরি করে, যা অ্যাসিড কমায়।
  • এতে থাকা অ্যান্টাসিড উপাদান গ্যাস্ট্রিকের বিরুদ্ধে কাজ করে।
  • কলা পাকস্থলীর অভ্যন্তরীণ ক্ষত নিরাময়েও সহায়ক।
  • যাদের পেটে অম্বল বা আলসার রয়েছে, তাদের জন্য কলা একটি নিরাপদ খাবার।

১১. ধূমপান ছাড়তে সহায়তা করে

  • ধূমপান ত্যাগের পর শরীরে যে ভিটামিন ও খনিজের ঘাটতি হয়, কলা তা পূরণ করে।
  • কলার ভিটামিন B6, B12, পটাসিয়াম ও ম্যাগনেশিয়াম নার্ভ সিস্টেমকে স্থিতিশীল করে।
  • এটি ধূমপান ছাড়ার সময় হওয়া মানসিক অস্থিরতা ও বিষণ্নতা কমায়।
  • প্রতিদিন কলা খেলে ধূমপান ত্যাগের যাত্রা সহজ হয়।

১২. কিডনি সুস্থ রাখে

  • পটাসিয়াম কিডনির ফিল্টার করার ক্ষমতা উন্নত করে এবং বিষাক্ত পদার্থ অপসারণে সহায়ক।
  • কলা নিয়মিত খেলে কিডনি স্টোন হওয়ার ঝুঁকি হ্রাস পায়।
  • এটি কিডনির রক্তপ্রবাহ উন্নত করে ও কর্মক্ষমতা বাড়ায়।
  • বিশেষ করে যাদের কিডনির সমস্যা আছে, তারা নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শে কলা খেতে পারেন।

কলার পুষ্টি গুণ চার্ট (প্রতি ১০০ গ্রামে আছে)

পুষ্টি উপাদানপরিমাণদৈনিক চাহিদার %গুরুত্ব
শক্তি৮৯ কিলোক্যালরি৪%দৈনন্দিন কর্মশক্তি যোগায়
কার্বোহাইড্রেট২২.৮ গ্রাম৮%প্রাকৃতিক শর্করা ও ফাইবার
ফাইবার২.৬ গ্রাম১০%হজমশক্তি বৃদ্ধি
প্রোটিন১.১ গ্রাম২%পেশি গঠনে সহায়ক
ফ্যাট০.৩ গ্রাম০.৫%স্বাস্থ্যকর চর্বি
পটাসিয়াম৩৫৮ মিগ্রা১২%রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ
ম্যাগনেসিয়াম২৭ মিগ্রা৭%মাংসপেশি শিথিলকরণ
ভিটামিন সি৮.৭ মিগ্রা১৫%রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা
ভিটামিন বি৬০.৪ মিগ্রা২০%মস্তিষ্কের কার্যকারিতা
ফোলেট২০ মাইক্রোগ্রাম৫%গর্ভবতী নারীদের জন্য উপকারী

সতর্কতা

  • কলায় প্রাকৃতিক চিনি থাকে, তাই ডায়াবেটিস রোগীদের পরিমাণ মতোই কলা খাওয়া উচিত। অতিরিক্ত কলা রক্তে শর্করার মাত্রা বেড়ে যেতে পারে।
  • যাদের কিডনির সমস্যা আছে, তাদের অতিরিক্ত কলা খাওয়া থেকে বিরত থাকা উচিত, কারণ পটাসিয়ামের বেশি গ্রহণ কিডনির উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
  • অনেকের শরীরে কলার প্রতি অ্যালার্জি থাকতে পারে, যার ফলে চুলকানি, ফুসকুড়ি বা শ্বাসকষ্ট হতে পারে। নতুন করে কলা খাওয়ার আগে সতর্ক থাকা জরুরি।
  • খালি পেটে অতিরিক্ত কলা খেলে কিছু মানুষের পেটে গ্যাস, অম্বল বা অস্বস্তি হতে পারে।
  • যদিও কলা স্বাস্থ্যকর, তবে অতিরিক্ত খেলে পটাসিয়াম বেশি হয়ে শরীরের ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে, যা হৃদরোগ ও কিডনিতে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। তাই দৈনিক ১ থেকে ২টি মাঝারি সাইজের কলা খাওয়া নিরাপদ ও উপকারী।

See also

পুষ্টিগুণে ভরপুর কোয়েল পাখির ডিম
দুধ খাওয়ার আগে জেনে নিন প্রয়োজনীয় এ তথ্যগুলো
শিশুদের যে খাবারগুলো ভুলেও খাওয়াবেন না

কলা খাওয়ার উপকারিতা

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top