Spread the love

রাজপরিবারে জন্মগ্রহণ করেও ধন-সম্পদ , ভোগ বিলাস ও প্রাচুর্যের মোহ যাকে আকৃষ্ট করতে পারেনি, যিনি ছিলেন মুসলিম বিশ্বের গৌরব তিনিই হলেন ইবনে সিনা । তার আসল নাম আবু আলী আল হুসাইন ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে সিনা। ইরান, তুরস্ক, আফগানিস্তান ও রাশিয়ার বিজ্ঞজনেরা তাঁকে তাদের জাতীয় জ্ঞানবীর হিসেবে দাবী করে। মধ্যযুগীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের ভিত রচনায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। আঠারো শতকের শেষ পর্যন্ত প্রায় ৭০০ বছর ধরে তাঁর লিখিত বই গুলো অক্সফোর্ড, কেমব্রিজসহ ইউরোপের নামীদামী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গুরুত্ব সহকারে পড়ানো হত। তিনি ছিলেন স্বাধীনচেতা ও আত্মমর্যাদাশীল সচেতন ব্যক্তি। আরবিতে ইবনে সিনাকে আল-শায়খ আল-রাঈস তথা জ্ঞানীকুল শিরোমণি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। ইউরোপে তিনি অভিসিনা নামে সমাধিক পরিচিত।

জন্ম ও বংশ পরিচয়ঃ

ইবনে সিনা ৯৮০ খ্রিস্টাব্দে তুর্কীস্তানের বিখ্যাত শহর বুখারার নিকটবর্তী আফসানা গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। আরবি পঞ্জিকা অনুসারে ৩৭০ হিজরী। তার পিতার নাম আবদুল্লাহ এবং মাতার নাম সিতারা বিবি। তার পিতা আবদুল্লাহ ইরানের প্রদেশ খোরাসানের শাসনকর্তা ছিলেন।

শিক্ষা জীবনঃ

ছোট বেলা থেকেই তাঁর মধ্যে লুকিয়ে ছিল অসামান্য মেধা ও প্রতিভা। মাত্র ১০ বছর বয়সে তিনি পবিত্র কুরআনের ৩০ পারা মুখস্ত করেন। তাঁর ৩ জন গৃহশিক্ষকের মধ্যে ইসমাইল সূফী শিক্ষা দিতেন ধর্মতত্ত্ব, ফিকহ শাস্ত্র ও তাফসীর; মাহমুদ মসসাহ শিক্ষা দিতেন গণিত শাস্ত্র এবং বিখ্যাত দার্শনিক নাতেনী শিক্ষা দিতেন দর্শন,ন্যায় শাস্ত্র, জ্যামিতি, টমেলির আল-মাজেস্ট, জওয়াহেরে মান্তেক প্রভৃতি। নাতেনী ইবনে সিনাকে পড়ানোর সময় তার মেধা দেখে বিস্মিত হয়ে যেতেন এবং তার পিতা আবদুল্লাহকে বলে ছিলেন-“আপনার ছেলে একদিন দুনিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী হবে। দেখবেন, ওর পড়াশোনায় কোনো ব্যাঘাত যেন না ঘটে।”

একটু বড় হওয়ার পর তিনি এ্যারিস্টটলের মেটাফিজিক্স পড়তে শুরু করেন কিন্তু অনেক কিছুই বুঝতে পারছিলেন না। কথিত আছে ৪০ বার তিনি সেই বইটি পড়েন এবং মুখস্ত করে ফেলেন। কিন্তু বইটির অনেক অর্থ তিনি আর বুঝতে পারছেন না। পরে তিনি দিরহাম দিয়ে আল-ফারাবির লেখা ব্যাখ্যা গ্রন্থ কিনে, সেটা পড়ার পর বিষয়গুলো পরিস্কার হয় তার কাছে। খুশিতে তিনি শুকরানা আদায়ের উদ্দেশ্যে গরীব-দুঃখিদের মাঝে ত্রান বিতরণ করেন।

ইবনে সিনা তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন – এমন বহু দিবারাত্রি অতিবাহিত হয়েছে যার মধ্যে তিনি ক্ষণিকের জন্যেও ঘুমাননি। কেবলমাত্র জ্ঞান সাধনার মধ্যেই ছিল তাঁর মনোনিবেশ। যদি কখনো কোন বিষয় তিনি বুঝতে না পারতেন কিংবা জটিল কোনো বিষয়ে সমস্যার সম্মুখীন হতেন তখনি তিনি মসজিদে গিয়ে নফল নামাজ আদায় করতেন এবং সেজদায় পড়ে আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করে বলতেন- “হে আল্লাহ তুমি আমার জ্ঞানের দরজাকে খুলে দাও। জ্ঞান লাভ ছাড়া পৃথিবীতে আমার কোন কামনা নেই।” তার পর গৃহে এসে আবার গবেষণা শুরু করতেন। ক্লান্তিতে যখন ঘুমিয়ে পড়তেন তখন অমীমাংসিত প্রশ্নগুলো স্বপ্নের ন্যায় তাঁর মনের মধ্যে ভাসতো। হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে উঠেই সমস্যাগুলোর সমাধান পেয়ে যেতেন।

বাদশাহর চিকিৎসা ও বিশ্বকোষ রচনাঃ

বুখারার বাদশা নুহ বিন মনসুর দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে ইবনে সিনা তাঁর চিকিৎসাবিদ্যা দিয়ে বাদশাহকে সম্পূর্ণ সারিয়ে তুলেন। বাদশা খুশি হয়ে ইবনে সিনাকে পুরস্কার দেয়ার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে। তিনি পুরস্কার হিসেবে বাদশাহর কাছ থেকে শাহি কুতুবখানায় প্রবেশ করে বই পড়ার অনুমতি চাইলেন। বাদশাহ তাঁর ইচ্ছানুযায়ী কুতুবখানা উন্মুক্ত করে দেওয়ার নির্দেশ দেন। মাত্র অল্প কয়েকদিনে তিনি অসীম ধৈর্য ও একাগ্রতার সাথে কুতুবখানার সকল বই মুখস্থ করে ফেলেন। জ্ঞান বিজ্ঞানের এমন কোনো বিষয় বাকি ছিল না যা তিনি জানেন না। মাত্র ১৯ বছর বয়সে তিনি চিকিৎসা শাস্ত্র, বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, রাজনীতি, অর্থনীতি, গণিত শাস্ত্র, জ্যামিতি, ন্যায় শাস্ত্র, সাহিত্য, কাব্য প্রভৃতি বিষয়ে অসীম জ্ঞানের অধিকারী হন। তিনি ২১ বছর বয়সে ‘আল-মজমুয়া’ নামক একটি বিশ্বকোষ রচনা করেন, যার মধ্যে গণিত শাস্ত্র ব্যতীত প্রায় সকল বিষয়াদি লিপিবদ্ধ করেছিলেন।

পিতার স্থলাভিষিক্ত হওয়াঃ

ইবনে সিনার ২২ বছর বয়সের সময় ১০০১ খ্রিস্টাব্দে তার পিতা ইন্তেকাল করেন। সুলতান নুহ বিন মনসুরের উত্তরাধিকারী নতুন সুলতান ইবনে সিনাকে তাঁর পিতার স্থলাভিষিক্ত করেন। তিনি বুখারা অঞ্চলের শাসনকর্তার অধীনে সরকারি কর্মকর্তার দায়ীত্ব পালন শুরু করেন। কিন্তু রাজনীতিতে তিনি ছিলেন নতুন। তাই তার রাজ্যের পূর্ব প্রান্তে ট্রান্সঅকসিনিয়ার বিদ্রোহ দেখা দিলে তিনি এ বিদ্রোহ দমনে ব্যর্থ হন। আত্মসম্মানবোধ থেকেই ইবনে সিনা চাকুরি ছেড়ে নিরুদ্দেশ যাত্রায় বেরিয়ে পড়েন। এই যাত্রায় তাঁর বিচিত্র অবিজ্ঞতা হয়েছিল।

ইবনে সিনা ছিলেন যুক্তিতে বিশ্বাসীঃ

বিনা যুক্তিতে তিনি কারো মতামত মেনে নিতেন না। এমনকি ধর্মের ব্যাপারও তিনি যুক্তির সাহায্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। তাই তৎকালীন সময়ে অনেকে তাঁকে ধর্মীয় উগ্রপন্থী এবং কয়েকজন বিখ্যাত পণ্ডিত তাঁকে কাফির বলে ফতোয়া দিয়ে ছিলেন। যারা তাঁকে কাফির ফতোয়া দিয়ে ছিলেন তাঁরা তাঁকে ভুল বুঝে ছিলেন। আসলে ইবনে সিনা ছিলেন একজন খাঁটি মুসলমান। যারা তাঁকে কাফির বলে ছিলেন, তাদের উদ্দেশ্যে তিনি একটি কবিতা রচনা করেন। কবিতাতে তিনি লিখেছেন, “ যারা আমাকে কাফির বলে আখ্যায়িত করে তাঁরা পৃথিবীতে বিখ্যাত হোক আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু আমার মতো যোগ্য ব্যক্তি তোমরা আর পাবে না। আমি এ কথাও বলতে চাই যে, আমি যদি কাফির হয়ে থাকি তাহলে পৃথিবীতে মুসলমান বলতে কেউ নেই। পৃথিবীতে যদি একজন মুসলমানও থাকে তাহলে আমিই হলাম সেই ব্যক্তি।”

আরও পড়ুনঃ বজ্রপাত থেকে বাঁচার কৌশল।

তাঁর রচনা ও আবিস্কারঃ

তিনি পদার্থ বিজ্ঞান, দর্শন, ধর্মতত্ত্ব, জ্যামিতি, গণিত, চিকিৎসা বিজ্ঞান, সাহিত্য প্রভৃতি বিষয়ে প্রায় শতাধিক গ্রন্থ রচনা করেন। এগুলোর মধ্যে আল-কানুন, আশ্‌ শেফা, আরযুযা ফিত তিব্ব, লিসানুল আরব, আল-মজনু, আল-মুবাদাউন মায়াদা, আল-মুখতাসারুল আওসাত, আল-আরসাদুল কালিয়া উল্লেখযোগ্য। আল-কানুন কিতাবটি তৎকালীন চিকিৎসা বিজ্ঞানে এক বিপ্লব এনে দিয়েছিল। কারণ এত বিশাল গ্রন্থ সে যুগে কেউ রচনা করতে পারেনি। আল-কানুন কিতাবটি ল্যাটিন, ইংরেজি, হিব্রু প্রভৃতি ভাষায় অনুদিত হয় এবং তৎকালীন ইউরোপের চিকিৎসা বিদ্যালয়গুলোতে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আল-কানুন ৫ টি বিশাল খণ্ডে বিভক্ত, যার পৃষ্ঠা ৪ (চার) লক্ষাধিক। কিতাবটিতে শতাধিক জটিল রোগের কারণ , লক্ষণ ও পথ্যাদির বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়া হয়।

আশ্‌ শেফা দর্শন শাস্ত্রের একটি অমূল্য গ্রন্থ, যা ২০ খণ্ডে বিভক্ত ছিল। এতে ইবনে সিনার রাজনীতি, অর্থনীতি, প্রাণীতত্ত্ব ও উদ্ভিদ তত্ত্বসহ যাবতীয় বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করে ছিলেন।

তিনিই সর্বপ্রথম ‘মেনেনজাইটিস’ রোগটি সনাক্ত করেন। পানি ও ভূমির মাধ্যমে ছড়ানো রোগ, সময় ও গতির সঙ্গে বিদ্যমান সম্পর্কের কথা তিনিই আবিস্কার করেছিলেন। তিনি এ্যারিস্টটলের দর্শন ভালোভাবে অধ্যায়ন করেন। কিন্তু এ্যারিস্টটলের কিছু কিছু মতবাদের সাথে তিনি একমত হলেও সকল মতবাদের সাথে তিনি একমত হতে পারেননি।

ভ্রমণঃ

তিনি পৃথিবীর অনেক দেশ ভ্রমণ করে। তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ নগরী  খোয়ারিজমে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি পণ্ডিত আল-বেরুনির  সাথে সাক্ষাৎ করেন। খোয়ারিজম থেকে বিদায় নিয়ে রাজধানী শহর গুরুগঞ্জে উপস্থিত হন। এই শহরে তাঁর জীবনের বেশ কিছু সময় অতিবাহিত করেন। এখানে অবস্থানকালেই  চিকিৎসা বিষয়ক অমর গ্রন্থ আল-কানুন ফিৎতিব রচনা করেন। এর পর চলে যান পূর্ব পারস্যের অন্তর্গত খোরাসানে। গজনীর সুলতান মাহমুদ ইবনে সিনার গুণের কথা শুনে তাঁকে তাঁর দরবারে নিতে চাইলে তিনি জর্জন নামক স্থানে চলে যান। এরপর চলে যান ইরানে। ইরানে যাওয়ার পথে তিনি তাঁর সমসাময়িক কবি ফেরদৌসীর জন্মস্থান তুস নগরী পরিদর্শন করেন। সেখান থেকে ইরানের সুপ্রাচীন শহর হামাদানে গমন করেন। হামাদানের সম্রাট তাঁর থাকা খাওয়া ও নিরাপদ চলাচলের ব্যবস্থা করেন। এখানেই তিনি তাঁর বিখ্যাত দর্শন গ্রন্থ আশ্‌ শেফা রচনা করেন। পরবর্তীতে হামাদানের সম্রাট তাঁকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ দেন। সেনা বিভাগের কর্মকর্তারা ইবনে সিনাকে সহ্য করতে না পেরে তাঁকে গ্রেফতারের জন্য সম্ম্রাটের কাছে আবেদন জানায়। কিন্তু সম্রাট তাঁকে দণ্ড না দিয়ে এক স্থানে বন্দি করে রাখেন। হামাদান থেকে তিনি ইরানের অন্যতম নগরী ইস্পাহানে ছলে যান। সেখানে গিয়ে তাঁর জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ কিতাব আল-ইশারাৎ রচনা করেন।

তাঁর শেষ জীবনঃ

শেষ জীবনে তিনি ইস্পাহান থেকে হামাদানে আসেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি কর্মব্যস্ত ছিলেন। তিনি তাঁর সকল সম্পদ দরিদ্রদের দান করে যান। পবিত্র কোরআন অধ্যয়নেই বেশি সময় ব্যয় করতেন। ১০৩৭ খ্রিস্টাব্দে এ মহা জ্ঞানী ও বিশ্ববিখ্যাত মনীষী মৃত্যুবরন করেন। তাঁকে হামাদানে সমাহিত করা হয়।


Spread the love