উচ্চ রক্তচাপ-এর ইংরেজি হল Hypertension । রক্তচাপ যদি ১৪০/৯০ মি.মি. পারদ চাপের বেশি থাকে তাহলে তাকে উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন বলা যেতে পারে। আবার রক্তচাপ ১৩৯/৮৯ টর থেকে ১২০/৮০ টর হলে সেটাকে প্রিহাইপারটেনশন বলা হয়। প্রিহাইপারটেনশন কোন রোগ নয়, কিন্তু প্রিহাইপারটেনশন আছে এমন ব্যক্তির উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশী থাকে।
উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার কারণঃ
বেশীরভাগ রোগীর ক্ষেত্রে উচ্চ রক্তচাপের নির্দিষ্ট কোন কারণ জানা থাকেনা। সাধারণত বয়স বাড়ার সাথে সাথে উচ্চ রক্তচাপের হারও বাড়তে থাকে। কিছু কিছু কারণ রয়েছে যেগুলো উচ্চ রক্তচাপ বাড়াতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। যেমন-
- অতিরিক্ত কাজের চাপ
- অতিরিক্ত মাত্রায় লবণ খাওয়া
- অতিরিক্ত মাত্রায় অ্যালকোহল পান করলে
- অতিরিক্ত আওয়াজ
- অতিরিক্ত ওজন বেড়ে গেলে
- পরিবারের কারো উচ্চ রক্তচাপ থাকলে
- ঘিঞ্জি পরিবেশে থাকা
- ধূমপান করা
- গর্ভধারণের কারণে
- অতিরিক্ত চর্বিজাতীয় খাদ্য খেলে
- অতিরিক্ত প্রক্রিয়াজাত খাদ্য খেলে
- অতিরিক্ত চিনিসমৃদ্ধ খাবার খেলে
- বয়স ৬৫ বছরের বেশি হলে
- অতিরিক্ত মানসিক চাপ
- পর্যাপ্ত পরিমাণে শাকসবজি না খেলে
- নিয়মিত হাঁটা-চলা বা ব্যায়াম না করলে
- অতিরিক্ত মাত্রায় ক্যাফেইনযুক্ত পানীয় (যেমন- চা, কপি) পান করলে

উচ্চ রক্তচাপের লক্ষণসমূহঃ
- অস্বস্তি বোধ করা
- শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া
- হঠাৎ বমি ও সাথে শ্বাস কষ্ট
- নাক দিয়ে রক্ত পড়া
- নিয়মিত মাথা ব্যথা
- অনিদ্রা
- ঘাড় ব্যথা
- অনিয়মিত হৃদস্পন্দন
- ক্লান্তি
- সর্বদা মেজাজ খিটখিটে থাকা
- মাথা ঘোরা
- বুক ব্যথা
- প্রস্রাবের সাথে রক্ত যাওয়া
- দৃষ্টিতে সমস্যা হওয়া
উচ্চ রক্তচাপ সম্পর্কে যা জানা দরকারঃ
- উচ্চ রক্তচাপ এমনই এক রোগ যে কোনও লক্ষণ ছাড়াই একে একে বিকল করে দিতে পারে হার্ট, ব্রেন, কিডনি, চোখসহ শরীরের নানান অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। তাই কোনও শারীরিক অসুবিধা না থাকলেও বছরে একবার স্বাস্থ্য পরীক্ষার সময় ব্লাড প্রেশার মেপে নেওয়া দরকার।
- হৃৎপিণ্ডের সংকোচনের মাধ্যমে অক্সিজেনযুক্ত রক্ত হৃৎপিণ্ড হতে সারা শরীরে ছড়িয়ে দেয়। এ সংকোচনের সময় চাপের পরিমাপ তুলনামূলক বেশি হয়ে থাকে। প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য সাধারণত ১২০ মিলিমিটার মার্কারি (mmHg), তবে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চাপের মাত্রা বাড়তে থাকে।
- সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, আজকাল আইসিইউতে থাকা রোগীদের অনেকেরই অসুস্থতার প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে হাইপোন্যাট্রিমিয়া। অর্থাৎ শরীরে সোডিয়ামের পরিমাণ ভীষণ ভাবে কমে গিয়ে সল্ট বা লবণের পরিমাণের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলার মতো সমস্যা। আবার গরমের দেশে একেবারে লবন খাওয়া বন্ধ করলে এই সমসয়ার ঝুঁকি বাড়ে।
- প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে অনেকেই উচ্চ রক্তচাপের শিকার। কিন্তু কারো কারো বেলায় দেখা যায় সেটা তারা জানেন না।
- পৃথিবীতে ২৫ বছরের উর্ধে জনসংখ্যার প্রায় শতকরা ৪০ ভাগ উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত। সারা বিশ্বে প্রতি বছর ১৭.৩ মিলিয়ন মানুষ উচ্চ রক্তচাপ অথবা উচ্চ রক্তচাপ সম্পর্কিত জটিলতায় মৃত্যু বরণ করেন।
- বেশিরভাগ মানুষই এই ধরনের উপসর্গ নিয়ে চিকিৎসকের কাছে যেতে চান না। লাগাতার এই ভাবে অনিয়ন্ত্রিত রক্তচাপ নিয়ে জীবনযাপন করলে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ একে একে বিকল হতে শুরু করে।
- উচ্চমাত্রার লবণের ব্যবহারের কারনে প্রায় শতকরা ৬০ ভাগ রোগী এই রোগে আক্রান্ত হন। উত্তরাধিকার সূত্রে উচ্চ রক্তচাপ একটি স্বাভাবিক ঘটনা। সাধারণত শতকরা ১০ ভাগ পর্যন্ত মহিলা গর্ভধারণের কারণে উচ্চ রক্তচাপের স্বীকার হন।
- সাধারণত ৪০-৪৫ বৎসর বয়সের মহিলাদের চেয়ে পুরুষদের উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বেশি। ৪৫ বৎসরের পরে গিয়ে পুরুষ-মহিলা উভয়েরই এই উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবে ডায়বেটিস এর ক্ষেত্রে এর সম্ভবনা আরও বেড়ে যায়।
- উচ্চ রক্তচাপ জনিত কারণে স্ট্রোক, হাইপারটেনসিভ, এনসেফালোপ্যাথি, প্যারালাইসিস, মস্তিষ্কে জটিলতা, মস্তিষ্কের সাবঅ্যারাকনয়েড স্পেসে রক্তক্ষরণ হয়ে থাকে। এছাড়া হৃৎপিন্ড বড় হয়ে যাওয়া, হার্ট অ্যাটাক ও ফেইলিউর, করোনারি হার্ট ডিজিজ প্রভৃতি। এটি চোখেরও বিভিন্ন ক্ষতি করে থাকে। যেমন – হাইপারটেনসিভ, রেটিনোপ্যাথি, দৃষ্টিশক্তির ব্যাঘাত, প্যাপিলিওডিমা।
- আসলেই উচ্চ রক্তচাপ এক জটিল ব্যাধি, যা ভয়ঙ্কর পরিণতি হঠাৎ মৃত্যুও ডেকে আনতে পারে। অনেক সময় উচ্চ রক্তচাপের কোনো প্রাথমিক লক্ষণ বা উপসর্গও দেখা যায় না। এটাই উচ্চ রক্তচাপের সবচাইতে মারাত্মক দিক। যদিও অনেক সময় উচ্চ রক্তচাপের রোগীর কোনো লক্ষণ থাকে না, তবুও নীরবে উচ্চ রক্তচাপ শরীরের বিভিন্ন অংশ বা অঙ্গকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এ জন্যই উচ্চ রক্তচাপ কে ‘নীরব ঘাতক’ বলা যেতে পারে।

উচ্চ রক্তচাপ হলে কি খাবেনঃ
গ্রিন টি, আঁশ যুক্ত খাবার,সব ধরনের ডাল, টক জাতীয় ফল, উপকারী চর্বি জাতীয় খাবার যেমন- সব ধরনের সামুদ্রিক মাছ, ছোট মাছ, উদ্ভিজ তেল এছাড়াও পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার। বাদাম, শস্যদানা, ডাল, চর্বি ছাড়া মাংস, মুরগি ম্যাগনেসিয়ামের ভালো উৎস। খাবারের সাথে বেশি পরিমাণে পটাশিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম চাইলে নীচের খাবারগুলো খেতে হবে যেমন আপেল, অ্যাপ্রিকট, কলা, শালগম, ব্রকলি, গাজর, আঙুর, বরবটি, তরমুজ, কমলা, আনারস, টমেটো। শর্করা জাতীয় খাবার যেমন ভাত, আলু, রুটি ইত্যাদি। মিষ্টি জাতীয় ফল যেমন পাকা আম, পাকা পেঁপে, পাকা কলা ইত্যাদি।
উচ্চ রক্তচাপ হলে কি খাবেন নাঃ
কোলেস্টেরলযুক্ত এবং সমৃদ্ধ চর্বি যুক্ত খাবার যেমন – ডিমের কুসুম, কলিজা, মাছের ডিম, খাসি বা গরুর চর্বিযুক্ত মাংস, হাস-মুরগীর চামড়া, হাড়ের মজ্জা, ঘি, মাখন, ডালডা, মার্জারিন, গলদা চিংড়ি, নারিকেল এবং উল্লেখিত এসব দ্বারা তৈরী খাবার। অতিরিক্ত লবণ খাওয়া যাবে না, পাতে লবণ ও নোনতা খাবার পরিহার করতে হবে। বিভিন্ন ধরনের ফাস্ট ফুড, কেক, পুডিং, আইসক্রিম, বোতল জাত কোমল পানীয় ইত্যাদি।
উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসা বা নিয়ন্ত্রণের উপায়ঃ
- দরকার না হলে হাসপাতাল বা ক্লিনিকে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। দীর্ঘ দিন ধরে যারা উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন তাদের অবশ্যই নিয়ম করে হার্ট, কিডনি, চোখ পরীক্ষা করাতে হবে।
- কোলস্টোরেলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
- ঘুমোতে যাওয়ার আগে উত্তেজক সিনেমা বা সিরিয়াল দেখা বন্ধ করুন।
- ঘাড়ে বা মাথায় ব্যথা বা মাথা ঘোরার মতো অসুবিধা হলে ফোনে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
- বাড়িতে থাকলেও নিয়ম করে ৪৫ মিনিট থেকে এক ঘণ্টা ঘাম ঝরানোর হাঁটাচলা আর ব্রিদিং এক্সারসাইজ (নিঃশ্বাসের ব্যায়াম) করতে হবে। গোসল-খাওয়ার মতোই এক্সারসাইজকে জীবনের অংশ করে নিন।
- সোডিয়াম রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয়। আবার সোডিয়ামের অভাবেও আচমকা স্ট্রোক হতে পারে। প্রতিদিন সব মিলিয়ে ৫ গ্রামের বেশি লবণ খাওয়া উচিত নয়। চানাচুর, চিপস জাতীয় প্রিজারভেটিভ দেওয়া খাবারে লবণ থাকে তাই এসব খাবেন না।
- কোন সুস্থ ব্যক্তির রক্তচাপ হঠাৎ করে বেড়ে গেলে উক্ত ব্যক্তিকে তাৎক্ষনিকভাবে অবশ্যই বিশ্রাম নিতে হবে। কিছু ক্ষেত্রে মাথায় পানি দিয়ে বা বরফ দিলে আরাম পাওয়া যায়। প্রেসার কমানোর জন্য অনেকে তেতুলের শরবত খেয়ে থাকেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এসব পন্থা কাজে দেয়না। তাই এক্ষেত্রে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। আর যাদের পূর্ব থেকেই উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা রয়েছে তাদেরও যদি হঠাৎ করে রক্ত চাপ বেড়ে যায় তাহলে অস্থির না হয়ে বিশ্রাম গ্রহন করতে হবে। মাথায় পানি বা বরফ ব্যবহারে সাময়িক উপশম পাওয়া গেলেও পরবর্তীতে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। রক্তচাপ কমানোর জন্য নিজে থেকে কোনো ওষুধ গ্রহণ না করাই ভালো।
- ডায়াবেটিস অথবা কিডনী রোগীদের ক্ষেত্রে, ১৩০/৮০ টরের অধিক রক্তচাপ হলেই সাবধান হতে হবে এবং বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে প্রয়োজনে চিকিৎসা শুরু করতে হবে।
- বংশগত উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধের তেমন ব্যবস্থা আবিষ্কৃত না হলেও জীবনযাত্রার পরিবর্তনের মাধ্যমে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি অনেকটাই কমানো সম্ভব। তাই যেসব বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণ করা যায়, সেগুলোর ব্যাপারে বেশি মনোযোগী হওয়া উচিত।
- বাজারে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য বহু রকমের ঔষধ রয়েছে যেগুলো অ্যান্টি-হাইপারটেনসিভ নামে পরিচিত যা রক্তচাপ কমিয়ে আনে। রক্তচাপ ৫-৬ টর কমালে তা স্ট্রোকের ঝুঁকি প্রায় ৪০%।
- স্বাস্থ্যবান্ধব জীবনযাত্রার মাধ্যমে রক্তচাপকে মাত্রার ভিতরে রাখা যায়। দরকার সচেতনতা সাথে ইচ্ছা।
পরামর্শঃ
- উচ্চ রক্ত চাপ নিয়ন্ত্রনে রাখুন।
- পরামর্শ পত্রে প্রদত্ত ওষুধ নিয়মিত সেবন করুন।
- ডায়াবেটিস ও কিডনি রোগ থাকলে তার চিকিৎসা করুন ও নিয়ন্ত্রনে রাখুন।
- ওজন নিয়ন্ত্রনে রাখুন।
- প্রতিদিন ব্যায়াম করুন।
- দুঃশ্চিন্তা মুক্ত থাকুন।
- অ্যালকোহল, ধূমপান, জর্দা, তামাক পাতা, গুল পরিহার করুন।
- সহজ-সরল স্বাভাবিক জীবনযাপন করুন।
আপনার একটু যত্ন আর কিছু ভালো অভ্যাস এই নীরব ঘাতক থেকে আপনাকে অনেক দূরে রাখতে পারে। তাই আজ থেকেই সচেতন হয়ে উঠুন এবং উচ্চ রক্তচাপের বিভিন্ন ঝুঁকি থেকে নিজেকে মুক্ত রাখুন।
আরও পড়ুনঃ হঠাৎ পায়ের রগে তান পড়লে কী করবেন ?
very important post.
Thanks
Good
Nice