সন্তান যখন একটু বড় হয় বা টিন-এজ বয়সে পৌঁছে তখন তার মধ্যে একটা ‘জ়েদি’ ভাব তৈরি হয়। একবার কোনো জিনিসের জন্য বায়না বা জেদ ধরলে সেটা পূরণ না হওয়া পর্যন্ত জেদ করেই যায়। কৌতূহল প্রবণতা আর স্বাধীনচেতা মনোভাবের কারণে সবকিছুকেই নিজের ইচ্ছামত পেতে চায় এবং নতুন নতুন বিষয় জানতে ইচ্ছে করে। মনে রাখবেন আপনি যত ঠান্ডা মাথায় ওর সমস্যা সমাধান করবেন, ভবিষ্যতে ও সেভাবেই নিজের সমস্যা সমাধান করতে শিখবে।
কখনো উল্টো রাগ করবেন নাঃ
সন্তান যখন রেগে যায় তখন নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। কিন্তু উল্টো বকাবকি করলে হিতে বিপরীত ফল হবে। এতে আপনার সন্তান আরো জেদি হয়ে উঠবে। কথায় তো আছে ‘রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন।’ তাই কখনো উল্টো রাগ দেখাবেন না। যখন আমরা রেগে থাকি, তখন কিছুই মাথায় ঢোকেনা, বুঝতে চাইনা। আপনার সন্তানের ক্ষেত্রেও কিন্তু তাই। তাই রাগ কমে গেলে যুক্তি দিয়ে বোঝান। এতে সন্তান মনে করবে আপনি ওর সমস্যা গুরুত্ব দিয়ে ভাবছেন।
সন্তান জেদ করার কারণ বের করুনঃ
কখনো কখনো শারীরিক সীমাবদ্ধতা, বা মানসিক কষ্টের কারণেও সন্তান জেদ করে থাকতে পারে। আবার মানসিক অস্থিরতার কারণেও হতে পারে। যদি প্রথমেই জানা যায় কি কারনে সন্তান জেদ করছে তাহলে তার সমাধান করার পথ সহজ হয়ে যায়।
অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ সম্পূর্ণ উপেক্ষা করুনঃ
মনোবিজ্ঞানের একটা সূত্র হলো- “যে আচরণ মনোযোগ বা প্রশ্রয় পায়, সেটা বেড়ে যাবে। আর যে আচরণ উপেক্ষিত হবে, সেটি ধীরে ধীরে কমে যাবে।” সুতরাং সন্তানের জেদ কমানোর প্রথম পদক্ষেপ হলো তার অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা অর্থাৎ জেদ নিয়ে কোনো কথা বলা বা প্রতিক্রিয়া না দেখানো। জেদ করে তার কোনো চাহিদা ক্রমাগত উপেক্ষিত হলে ধীরে ধীরে এ আচরণ কমে আসবে।
অতিরিক্ত কঠোর শাসন এবং অতিরিক্ত প্রশ্রয় দিবেন নাঃ
সন্তান বড় হওয়ার সাথে সাথে আবেগপ্রবণতা বাড়তে থাকে। এই সময় অভিভাবকদের অতিরিক্ত কঠোর শাসন আবার অতিরিক্ত প্রশ্রয়ের কারণে সন্তানের জেদি মনোভাব তৈরি হতে পারে।
কিছু চাহিদা অপূর্ণ রাখুনঃ
আপনার সামর্থ্য থাকলেও সন্তানের কিছু চাহিদা অপূর্ণ রাখুন। এতে সন্তান যেমন বুঝতে শেখে সব ইচ্ছা সব সময় পূরণ হয় না, তেমনি সে শেখে ‘না পাওয়াকে’ কীভাবে মানিয়ে নিতে হয়। ছেলেবেলা থেকেই এই মানিয়ে নেওয়ার শিক্ষা, প্রাপ্ত বয়সে জীবনের নানা ‘না পাওয়া’, ব্যর্থতা, অপ্রতাশিত ঘটনা সহজভাবে মেনে নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে।
পছন্দের সুযোগ দিনঃ
জেদি বাচ্চারা তাদের দাবির বিরুদ্ধে ‘না’ কথাটা শুনতে চায় না। যেটা আপনি ‘না’ বলবেন সেটা করার ক্ষেত্রেই তাদের মনোযোগ বেশী আকর্ষিত হবে। ফলে তাদের অন্য পছন্দের সুযোগ দিন।
আদর এবং স্নেহ দিয়ে বোঝানঃ
জেদ কমে আসলে আদর ও স্নেহ দিয়ে বোঝাতে হবে, সে যা ব্যবহার করছে তা পরিবারের কারোও কাছেই গ্রহণযোগ্য নয়। রাস্তায় , অন্য কারো বাড়িতে কিংবা অন্য কারো উপস্থিতিতে বাচ্চাকে বকবেন না। ছোটদের কিন্তু আত্মসম্মানবোধ প্রবল। এরকম করলে বাচ্চা আরও বেশি জেদি হয়ে ওঠে। ওকে আলাদা করে ডেকে কথা বলুন। তার নিজস্ব চাহিদা থাকতে পারে, ওর কথা মন দিয়ে শুনুন। আদর এবং স্নেহ দিয়ে বোঝালে বাচ্চারা অনেক সহজে বুঝবে। এইভাবে তার মধ্যে সেল্ফ কন্ট্রোল বোধ তৈরি হবে।
বাচ্চাদের শপিং মলে কম নিয়ে যাবেনঃ
অনেকসময় বাচ্চারা বাড়ীর বাইরে গেলে জেদের প্রকাশ ঘটায়। শপিং শপিং মল জাতীয় জায়গায় বাচ্চাদের যতটা কম নিয়ে যাওয়া যায় ততই ভালো। বাচ্চাদের বিনোদনের জায়গা হল খেলার মাঠ, শপিং মল নয়। যদি একান্তই নিয়ে যেতে হয় তাহলে তাকে আগে থেকেই বুঝিয়ে বলুন তারপর নিয়ে যান।
সন্তানের আত্মসম্মান এবং আত্মমর্যাদাবোধ খেয়াল রাখুনঃ
বয়সে অতি ছোটো হলেও প্রতিটি শিশুরই আত্মসম্মান এবং আত্মমর্যাদা বোধ আছে। আপনি সব সময় বা সবার সামনে কান ধরে বা চুল ধরে নির্দেশ দিলেই যে সে পালন করবে তা নয় বরং তার কথাকেও গুরুত্ব দিন। দেখবেন আপনি যা ভেবেছেন তার চেয়েও অনেক বেশি ভাবনা ভেবে রেখেছে সে।
খেলাধুলোতে উৎসাহ দিনঃ
কিছু বাচ্চা খুব চঞ্চল হয়, এক মুহূর্ত স্থির থাকতে চায় না। এরকম ক্ষেত্রে বাচ্চাদের ছুটোছুটি করে খেলাধুলো করতে উৎসাহ দিন। দেখবেন বাচ্চার অহেতুক দুষ্টুমির প্রবণতা অনেকটা কমে আসবে।
সন্তানকে তিরস্কার করবেন নাঃ
যেকোন ব্যর্থতায় সন্তানকে তিরস্কার না করে তাকে পরবর্তীতে ভালো করার জন্য উদ্বুদ্ধ করুন। আপনি যে তার উপরে ভরসা করছেন এটি তাকে বুঝিয়ে দিন।
সন্তানের মধ্য দায়িত্ববোধ গড়ে তুলুনঃ
বাচ্চা একটু বড় হলে ওকে নিজের সিদ্ধান্ত নিতে দিন। ঘরের ছোটখাটো কাজের দায়িত্ব দিন। নিজের জিলিস গুছিয়ে রাখার কাজ সন্তানের মধ্যে দায়িত্ববোধ গড়ে তোলে। নির্দিষ্ট সময় ঘুম থেকে ওঠা, পড়তে বসা, খাওয়া বা খেলাধুলার অভ্যেস করান। ছোটবেলা থেকে ডিসিপ্লিনের মধ্যে থাকলে সন্তানের মধ্যে আত্মনিয়ন্ত্রণ তৈরি হয়।
ধৈর্য হারাবেন নাঃ
মনে রাখবেন বাচ্চারা কোমলমতি। এক ভুল বার বার করতেই পারে। তাই বলে ধৈর্য হারিয়ে ফেললে চলবে না। ওকে সুযোগ দিন। তবে খেয়াল রাখুন কাজটা যে ভুল বা অন্যায় সেই বোধটা যেন ওর গড়ে ওঠে।
আপনার কথার গুরুত্ব দেয় কিনা সেদিকে নজর রাখুনঃ
অনেকেই সন্তানের জন্য অবশ্য পালনীয় কিছু নিয়ম তৈরি করেন কিন্তু তা পালন করা হছে কীনা সে বিষয়ে নজর দেন না। কিন্তু মনে রাখুন এটা কিন্তু খুব গুরুতবপূর্ণ ব্যাপার। আপনি যদি আপনার সন্তানকে খেলতে যাওয়ার আগে দুধ খেয়ে যেতে বলেন তবে সেটা যাতে সে পালন করে তা দেখতে হবে আপনাকেই। যদি সে তা না করে তবে আপনিও তার খেলার সময় কম করার শর্ত চাপাবেন।
নেতিবাচক আচরণ করা থেকে বিরত থাকুনঃ
সন্তানের সাথে কখনোই নেতিবাচক আচরণ করবেন না। সন্তানের অথবা পরিবারের অন্য কারো গায়ে হাত তোলা, অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করা সহ যে কোনো নেতিবাচক আচরণ থেকে সন্তানকে দূরে রাখুন। কখনও কখনও অভিভাবকরা সন্তানদের প্রতি বিরূপ আচরণ বা ধারণা পোষণ করেন। যেমন তোকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না, অন্যের সাথে বারবার তুলনা করা সহ বিভিন্ন ধরনের কটু কথা বলে থাকে। এই ধরনের নেতিবাচক আচরণের ফলে সন্তানের ভেতরে ভালোবাসার অভাব বোধ তৈরি হতে পারে।
নিজেকে পরিশুদ্ধ করুনঃ
আপনার সন্তান জীবনের বেশিরভাগ সময়ই আপনাকেই দেখতে থাকে। তাই নিজেকে এমনভাবে তৈরি করুন যাতে সন্তান তার আদর্শ হিসেবে আপনাকেই গ্রহণ করে। আপনি যদি নিজেই রেগে যান, মন্দ কথা বলেন , মিথ্যা গীবত এবং অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ করেন, তাহলে খুব স্বাভাবিক ভাবে আপনার সন্তান সেটাই শিখবে। তাই নিজেকে পরিশুদ্ধ করার চেষ্টা করুন যাতে আপনার সন্তান একজন পরিশুদ্ধ আদর্শবান মানুষ হিসেবে আপনাকেই অনুসরণ করতে পারে।
সুস্থ বিনোদনের ব্যবস্থা করুনঃ
বাচ্চারা অনেক সময় হরর মুভি এবং সহিংসতামুখী সিরিয়ালের ভক্ত হয়ে পড়ে। দেখা যায় এই সব থেকে প্রভাবিত হয়ে তারা মারামারি, ভাংচুর ইত্যাদি করে থাকে। আর তাইতো সময় থাকতে তার এই সব সহিংসতা সম্বলিত মুভি এবং সিরিয়াল দেখা বন্ধ করুন। বরং তাকে ভালো শিশুতোষ মুভি এবং শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান দেখতে দিন।
সন্তানকে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যানঃ
বাচ্চার জেদ, চঞ্চলতা ও সহিংস আচরণ যদি কোনভাবেই সংশোধন করতে না পারেন, তবে তাকে মনোচিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান। অনেক সময় অটিজমে আক্রান্ত বাচ্চারা প্রচণ্ড জেদি আর একগুঁয়ে স্বভাবের হয়ে থাকে।
গুরুত্বপূর্ণ কিছু টিপসঃ
- সন্তানের ভাল কাজের প্রশংসা করতে ভুলবেন না।
- জেদ নিয়ে বাচ্চার সামনে অন্যদের সঙ্গে গল্প করবেন না।
- ভালো কাজে জন্য পুরস্কার দিন।
- সন্তানের কে যে আপনি ভালবাসেন সেটা আচরণ এবং মুখে প্রকাশ করুন।
- জেদের সময় অতিরিক্ত বোঝানো, বকা দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
- বয়স অনুযায়ী পরিবারের ছোটখাটো দায়িত্ব দিন।
- যে জিনিসটির জন্য সন্তান বায়না ধরবে তার পরিবর্তে তাকে সবসময় কিছু না কিছু দিন।
- সামাজিক মূল্যবোধ, সংস্কৃতি, নিয়ম, আদবকায়দা ইত্যাদি শেখানোর কাজে আপনিও ভূমিকা নিন।
- সন্তানকে প্রতিদিন একই ধরনের খাবার খেতে দেবেন না।
- সারা দিনের কাজের মধ্যেও সন্তানকে যথেষ্ট সময় দিন, মুড বোঝার চেষ্টা করুন এবং তাদের সাথে খেলাধুলো করুন।
- সন্তানকে রাগারাগি বা মারধোর করবেন না।
- সন্তান কোনো বিষয়ে বায়না ধরলে খুব বেশি প্রতিক্রিয়া দেখাবেন না।
- তার শারীরিক, মানসিক, আবেগজনিত যেকোনো পরিবর্তনে তার সাথে বন্ধুসুলভ আচরণ করুন।
- বাচ্চার হাতে মোবাইল, ট্যাবলেট, ভিডিও গেমস ইত্যাদি না দিয়ে গল্পের বই, বিভিন্ন ভ্রমণকাহিনী, মনীষীদের জীবনী ইত্যাদি তুলে দিন।
- সন্তানের ব্যক্তিগত বিষয়ে আপনার নিজস্ব মতামত চাপাবেন না।
- মনে আঘাত দিয়ে বা অসম্মান করে কথা বলা এবং কারো সাথে তুলনা করা থেকে বিরত থাকুন
আরও পড়ুন, আপনার সন্তানের বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলবেন যেভাবে।