Spread the love

শিশুর দুই বছর থেকেই বই পড়ার একটা পরিবেশ গড়ে তোলা প্রয়োজন। বই পড়ার অভ্যাসের মাধ্যমে মেধায়, মননে ও সৃজনশীলতায় আমাদের প্রজন্ম গড়ে উঠবে পরিশীলিত ও মানবীয় গুণে। নতুন প্রজন্মকে এই অসাধারণ কল্পনাশক্তির বীজ তুলে দিতে হবে তার পাঠের অভ্যাস গড়ে তোলার মাধ্যমে। সন্তানদেরকে মোবাইল, ইন্টারনেট আর ফেসবুকের নেশা কাটিয়ে দিতে পারে বইয়ের নেশা। কিন্তু সে নেশাটি ধরাতে হবে অভিভাবকদের প্রাণান্তকর চেষ্টায়। অভিভাবক হিসেবে আপনার দায়িত্ব শুরু হয়ে যাবে আপনার শিশুটি কথা বলতে শুরু করার সাথে সাথেই।

টেনশন মুক্ত থাকুনঃ

শিশুদের সামনে টেনশন করবেন না, আতঙ্কে ভুগবেন না। ওর সামনে অন্তত মনের ভাব চেপে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করুন। না হলে ওর মধ্যেও এক ধরনের অস্থিরতা জন্ম নেবে। বাড়ির পরিবেশ যদি শান্ত স্বচ্ছন্দ থাকে, বাচ্চার স্বভাবে তার প্রভাব পড়ে।

শিশুদের কথা মন দিয়ে শুনুনঃ

বাচ্চার সঙ্গে কথা বলুন। আর ওর কথা মন দিয়ে শুনুন। মা-বাবা ধীরস্থির হয়ে, মন দিয়ে বাচ্চার কথা শুনলে স্বভাবতই ওর অতিরিক্ত ছটফটে ভাব কমে আসবে। ওর হোমওয়ার্ক ওকেই করতে দিন। স্কুলে বকুনি খাওয়ার ভয়ে নিজেরা করে দেবেন না। এতে ও পড়ার গুরুত্ব বুঝতে পারবে।

বই পড়ার জন্য পরিবেশ তৈরি করুনঃ

বই পড়ার জন্য পরিবেশ অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ শান্ত নির্জন পরিবেশে বই পড়ার দিকে মনোযোগ দেওয়া যায়। কিন্তু কোলাহলপূর্ণ পরিবেশে সেটা কখনো সম্ভব নয়। শিশুদের স্কুলে পাঠানোর আগেই, বাড়িতে গড়ে তুলুন পড়ার পরিবেশ। এতে শিশুর শেখার ইচ্ছা জাগবে।

শিশুদের সামনে বইয়ের পাতা উল্টিয়ে পড়ুনঃ

নিয়মিতভাবে রাত্রে অন্তত ১৫ মিনিট শিশুকে কোলের কাছে নিয়ে বইয়ের পাতা উল্টোন। বই পড়তে, দেখতে ও পাতা উল্টোতে অভ্যস্ত হলে পরবর্তীকালে পড়াশোনা করার সময় ধৈর্য্য সহকারে মনোযোগ দিতে ওর অসুবিধা হবে না।

বর্ণমালার বই হাতে দিনঃ

শিশুকে স্কুলে ভর্তি করার আগেই বাসায় খেলতে খেলতে বর্ণমালার বই দিন। এতে স্কুলে ভর্তির পর যখন সে দেখবে সে ভালো পারছে, তখন তার আত্মবিশ্বাস বাড়বে।

বর্ণমালা শিখানঃ

বর্ণমালার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে পারেন শিশুটিকে। তবে মনে রাখা উচিত, এ সময় আপনি কখনোই ‘অ’ হতে ‘ঐ’ পর্যন্ত কিংবা ‘ক’ হতে ‘চন্দ্রবিন্দু’ পর্যন্ত মুখস্ত করাতে যাবেন না। এতে তার মস্তিষ্কের উপর যেমন অযথা চাপ পড়বে, সাথে সাথে সে পড়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। এর চেয়ে বরং আপনি তাকে একটি একটি করে বর্ণ চেনাতে আরম্ভ করুন, কোন ধারাবাহিকতা না রেখেই। প্রথমে ‘কার’ ও ‘ফলাবিহীন’ শব্দ যেমন ‘কলম’ ‘বয়স’ ইত্যাদি দিয়ে শুরু করুন। এরপর ধীরে ধীরে যুক্তবর্ণগুলোও চিনিয়ে দিন।

খেলার ছলে পড়ানোর অভ্যাস করুনঃ

যখন ৬ বছরে পা দিবে তখন আপনার শিশুকে তার স্কুলে যাওয়ার অভ্যাস রপ্ত করা জরুরী হয়ে পড়ে। এ সময়ে তাকে অবশ্যই একটি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়া উচিত। অনেক অভিভাবকের অভিযোগ শোনা যায়, শিশুর পড়ার আগ্রহ কম। তবে জেনে রাখা ভালো এ বয়সে শিশুরা কিন্তু খেলতে বেশি পছন্দ করে। তাই তাকে খেলার ছলে পড়াতে হবে। খেলার সময় তাকে কবিতা শোনাতে পারেন। এ সময় শিশুরা শুনতে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে।

শিশুর সাথে বসে নিজেও পড়ুনঃ

শিশুদের পড়াতে গেলে দেখা যায়, তাদের পড়ে পড়ে পড়াতে হচ্ছে। তা না করে, নিজে বরং অন্যকিছু অর্থাৎ ভাল ভাল ও প্রয়োজনীয় বিষয় নির্ধারন করে ধর্মীয় বা সামাজিক বিষয়ের বই পড়ুন। আপনার পড়া দেখে শিশুটিও তার পড়া পড়তে উৎসাহ বোধ করবে।

সঠিক বইটি আপনার শিশুর জন্য বাছাই করুনঃ

অনেক সময় শিশুরা বই পড়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে কারণ বইগুলো তাদের বয়স উপযোগী হয় না। তাই সঠিক বইটি বাছাই করা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বয়স যদি ৪-৫ বছরের নিচে হয় তাহলে এমন বই কিনুন যেখানে একটি পৃষ্ঠায় ৩-৪ লাইন করে থাকে। ছোট শিশুদের জন্য আরও কম লাইন হলে ভালো। কালারফুল বই হতে হবে অবশ্যই। লেখার ভাষা হতে হবে খুব সহজ।

গল্পের বই পড়ার অভ্যাস গড়েতুলুনঃ

স্কুলের বইয়ের পাশাপাশি অন্যান্য সব বই পড়ার অভ্যাসটা শিশুর মধ্যে তৈরি করে দেয়াটা খুব জরুরী। আমাদের অভিভাবকদের অনেকেরই ধারণা যে, গল্পের বই পড়ার মানে হচ্ছে স্কুলের পড়া থেকে অমনযোগী হয়ে প্রতিযোগিতা থেকে পিছিয়ে পড়া! এটা ভুল একটা ধারণা। ঘুমানোর আগে শিশুকে বই দেখে পড়ে গল্প শোনাতে পারেন। এটাও একটা ভাল প্র্যাকটিস। আবার আপনি নিজে গল্প না পড়ে শিশুটিকে দিয়েও পড়াতে পারেন। এতে করে শিশুর উচ্চারণ ও জড়তা কেটে যাবে। মনীষীদের জীবনী, শিক্ষামূলক বই ও জীবনঘনিষ্ঠ সাহিত্য পড়তে উৎসাহ দিন।

শিশুকে জোর করে পড়তে বসাবেন নাঃ

শিশুর যা পড়তে ভালোলাগে তাকে তাই পড়ান। শিশু বুঝবেনা এটাই স্বাভাবিক। তার এই না বোঝা নিয়ে গালমন্দ করবেন না। তাকে না পারলে বারবার বুঝিয়ে বলুন। ছোট ছোট বিষয় গুলোতে উৎসাহ দিন। শিশুকে জোর করে পড়তে বসাবেন না।

প্রশ্ন করতে উৎসাহ দিনঃ

শিশুরা একটু বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আশপাশের সব কিছু নিয়ে জানতে চায়। তার চোখে থাকে রাজ্যের বিস্ময়। এ সময় আপনার কাজ হবে তার জানতে চাওয়া প্রশ্নের ক্রমাগত উত্তর দেয়া। এখানে লক্ষ্য রাখার বিষয় হচ্ছে- তার প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে যেন আপনি ক্লান্ত হয়ে না যান এবং রেগে গিয়ে তাকে ধমক না দেন। আপনি তার এই উৎসুক মনটার সাহায্য নিয়েই তার সঙ্গে বইয়ের সম্পর্ক জুড়ে দিতে পারেন খুব ছোট বয়সেই। প্রশ্ন অনেক বড় শেখার একটি মাধ্যম। শিশুকে নানা ভাবে প্রশ্ন করতে উৎসাহ দিন। তার যত জানার আগ্রহ জন্মাবে তার তত পড়তে ইচ্ছে করবে। তাই শিশুকে নানা প্রশ্ন করে তাকে পড়তে আগ্রহী করে তুলুন।

শিশুকে উপহার দিনঃ

শিশুরা সাধারণ বিভিন্ন জিনিস আঁকতে ও রং করতে পছন্দ করে। শিশুদের কাছে স্কুলে যাওয়া-আসা ও পড়ায় মনোযোগ বাড়তে নতুন ও রঙিন সব নতুন ব্যাগ, খাতা আর নতুন রং পেনসিল বক্স উপহার দিন। তাকে বিভিন্ন জিনিস এঁকে দিন এবং রং করতে সাহায্য করুন। শিশুকে নিজের মতো করে ছবি আঁকতে দিন। কখনো ভাববেন না, সময় নষ্ট হচ্ছে। ছবি আঁকা শিশুর মেধা বিকাশে সাহায্য করে।

শিশুর পড়ার জন্য একটা নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দিনঃ

আজকের ইন্টারনেট, স্মার্ট ফোনের যুগে শিশুর নেশা নিবদ্ধ হয়ে থাকে অজানা ও স্পর্শকাতর জিনিসের প্রতি। সেজন্যেই, শিশুর পড়ার জন্য একটা নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দিতে হবে। ঐ সময়টিতে প্রতিদিন একটি করে বই পড়তে হবে। এ কাজে উৎসাহিত করতে বাচ্চাকে ছোটখাটো পুরস্কার বা সারপ্রাইজ দেয়ার ব্যাবস্থাও রাখা যেতে পারে।

শিশুর পড়ার টেবিল ঘুছিয়ে রাখুনঃ

শিশুর পড়ালেখার জন্য আগ্রহের একটি কেন্দ্রবিন্দু থাকে তার পড়ার টেবিল। তাই পড়ার টেবিলটির প্রতি যত্নশীল হওয়া প্রয়োজন। শিশুর পড়ার টেবিলটি সাজিয়ে দিন।

পড়ার পাশাপাশি তাদের লিখতে উৎসাহ দিনঃ

তাকে নিজের থেকে ছড়া কিংবা আজ স্কুলে সে কী কী করল তা লিখতে বলুন। এতে করে তার সৃজনশীলতা বৃদ্ধি পাবে। তার লেখায় অনেক ভুল থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। তাকে সবার আগে চমৎকার লেখার জন্য বাহবা দিয়ে অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে ভুলগুলো ধীরে ধীরে শুধরে দিন।

ডায়েরি লেখার অভ্যাস করুনঃ

কোথাও বেড়াতে নিয়ে গেলে ফিরে এসে ডায়েরি লেখার মত করে তাকে ভ্রমণ কাহিনী লিখতেও উদ্বুদ্ধ করতে পারেন। এতে ভ্রমন-সাহিত্যের প্রতি উৎসাহ বাড়তে পারে। এমনি করে যেকোনও বিষয়ে শিশুর মধ্যে এক ধরনের আগ্রহ তৈরি করে দেয়া খুবই সহজ। শুধু আগ্রহ তৈরি করে দিলেই হবে না, সেগুলোকে গুরুত্বও দিতে হবে আপনাকেই। নাহলে আবার আগ্রহ তৈরি হয়ে হারিয়েও যেতে পারে।

শিশুকে ঘুরতে নিয়ে যানঃ

শিশুরা ঘুরতে ও খেলাধুলা করতে পছন্দ করে। আপনি যতই ব্যাস্ত থাকুন না কেনো, সন্তানের সাথে সপ্তাহে অন্তন একটি দিন কাটান। তাকে বাইরের জগতের সাথে পরিচিত গড়তে সাহায্য করুন। নানা জিনিস সম্পর্কে তাকে ধারণা দিন। দেখবেন শিশুর ভেতরে শেখার আগ্রহ বাড়ছে। এছাড়া সময় পেলে তাকে নিয়ে শিশুপার্ক বা পছন্দের কোনো জায়গায় ঘুরতে যেতে পারেন।

কল্পনার জগৎকে ভরিয়ে তুলুন বইয়ের রাজ্যেঃ

 প্রতিদিন শিশুদের সঙ্গে কিছু না কিছু পড়ুন ও পড়ান। পড়ার জন্য এমন কোনো বিষয় বেছে নিন যা শিশুর সঙ্গে সঙ্গে আপনারও ভালো লাগবে। সেটা হতে পারে অত্যন্ত ছন্দময় মজার কোনো সহজ কবিতা, হতে পারে ছোট কোনো গল্প বা রূপকথা, কিংবা হতে পারে জনপ্রিয় কোনো কার্টুন বই।

বই কিনতে শিশুকে লাইব্রেরিতে নিয়ে যানঃ

সপ্তাহের বন্ধের দিনগুলোতে আপনার সন্তানকে নিয়ে বিভিন্ন বইয়ের দোকান থেকে ঘুরে আসুন। এতে করে সে যেমন নতুন বইয়ের ঘ্রাণ পাবে যা তাকে বইয়ের প্রতি আরো আগ্রহী করবে, একই সাথে বইয়ের দোকান এবং লাইব্রেরিতে যাওয়ার প্রতিও আগ্রহী করবে।

নিজস্ব  বইয়ের সংগ্রহ গড়ে তুলতে সাহায্য করুনঃ

সংগ্রহ করুন নানা ধরণের বই। সুবিধামত জায়গায় একটি লাইব্রেরি করুন। আপনার বইয়ের আলমারি যদি আপনার পছন্দের বইয়ের সংগ্রহে পূর্ণ থাকে, আপনার সন্তান নিজেও তার ব্যক্তিগত লাইব্রেরি তৈরি করতে ইচ্ছুক হবে । তার রুমে একটি বইয়ের তাক রাখুন অথবা তাকে আপনার নিজের বইয়ের আলমারি থেকে কিছু জায়গা করে দিন। সে হয়ত সযত্নে তার পছন্দের বইগুলো তার জন্য রাখা জায়গাটিতে সাজিয়ে রাখবে। এতে করে সে বইয়ের যত্ন নেয়া শিখবে এবং বই পড়ার প্রতি আরো বেশি আগ্রহী হবে।

আরও পড়ুন, জেদি ও চঞ্চল সন্তান সামলানোর সহজ উপায়।


Spread the love